সাইকেল চালিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন বৃদ্ধা

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

নন্দিনী ডেস্ক
বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। শ্রম, মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে তারা। এরই মধ্যে দুঃসাহসী ও চ্যালেঞ্জিং কর্মকান্ডে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে অনেকে। এই ধারাবাহিকতা এখন শুধু শহরে নয় উপজেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামেও যুক্ত আছেন বিভিন্ন কর্মকান্ড ও মানবসেবায়। নানা রকম যুদ্ধ পাড়ি দিয়ে একমাত্র নিজের সাহসিকতায় অনেক নারীর সফলতার গল্প আমরা শুনেছি। তবে আজ জানাবো অন্যরকম এক গল্প। গ্রামের সবাই যাকে চেনেন নানি নামে। তিনি হলেন জহিরন বেওয়া। বয়স তার অনেক কিন্তু মনের উদ্যমতা, সাহসিকতা, কর্মের দক্ষতা-সখ্যতা কমেনি তার। স্থানীয় এমপিও কারও কাছে অপরিচিত হলেও গ্রামের সবার কাছে নানি জহিরন বেওয়া এক পরিচিত নাম। জহিরন বেওয়া লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউপির সীমান্তবর্তী গ্রাম তালুক দুলালীর মৃত সায়েদ আলীর স্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের চার বছর আগে স্বামীর মৃতু্যতে ভেঙে পড়া এ সংগ্রামী নারী তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার সংগ্রাম শুরু করেন। আট বছর আগে বড় ছেলে দানেশ আলী মৃতু্যবরণ করায় ভেঙে পড়েন জহিরন বেওয়া। ছোট ছেলে তোরাব আলীর সংসারে এই সংগ্রামী নারী এখনো সচল, সজাগ আর কর্ম উদ্যমী হয়ে বেঁচে আছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু সংসারে অভাব-অনাটন ছিল প্রতিক্ষণের চিন্তা। সমাজের কথা উপেক্ষা করে ১৯৬৮ সালে জহিরন পরিবার পরিবল্পনার অধীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, চুক্তিভিত্তিক মাসিক মজুরিতে কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে কর্মে যোগ দেন। নিজ গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে বাইসাইকেল চালিয়ে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতেন। ২০০ থেকে ৩০০ অবশেষে ৫০০ টাকা মাসিক মজুরিতে ১০ বছর চাকরি করে অবসরে যান জহিরন। কিন্তু বাড়িতে বসে থাকতে পারেননি। জহিরন বেওয়া বলেন, 'আমি শুধু সাধারণ রোগ যেমন জ্বর, মাথাব্যথা, বমি শারীরিক দুর্বলতাসহ অন্যান্য রোগের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি। চিকিৎসার জন্য আমাকে কোনো অর্থ দিতে হয় না, তবে আমি বাজারমূল্যে তাদের কাছে ওষুধ বিক্রি করি। এতে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ টাকা আয় হয়। তিনি আরও বলেন, আদিতমারী উপজেলার ৩০টি গ্রামে প্রায় দুই হাজারের বেশি পরিবারের সঙ্গে রয়েছে আমার যোগাযোগ। আমি প্রতিদিন বাইসাইকেল চালিয়ে কমপক্ষে সাতটি গ্রামের ৭০টি বাড়িতে যাই এবং তাদের খোঁজখবর নিই। এমনটি দাবি করে জহিরন বেওয়া জানান, গত ৫০ বছরে তিনি কোনো রোগে আক্রান্ত হননি। আদিতমারীর গ্রামবাসীরা জানান, গত ৪৫ থেকে ৫০ বছর ধরে জহিরন বেওয়াকে দেখছি তিনি সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে দরিদ্র রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ কোনো অসুখ-বিসুখ হলে আমরা তার কাছেই চিকিৎসা নিই। আর তিনি কখনোই আমাদের কাছে টাকা নেননি। মাঝেমধ্যে ওষুধও বিনামূল্যে দেন। তারা জানান, তিনি এখন ত্রামের সবার জাতীয় নানি। সবাই তাকে নানি বলেই ডাকে, হয়তো ছেলে দেখলে তাকে নানি বলে ডাক দেয়, ছেলের বাবাও দেখলে নানি বলে ডাকে। অনেকে আবার আদর করে তাকে নানিবুড়ি বলে ডাকেন। আমাদের এই অঞ্চলে সবাই নানিবুড়ি বললে জহিরন বেওয়াকে এক নামে চেনে, এমনকি আমাদের এমপিকে কেউ চিনুক না চিনুক কিন্তু এই নানিবুড়িকে আশপাশের সব লোক এক নামে চেনে। তারা আরও জানান, নানিকে ভালোবেসে অনেকে পরামর্শ দেয়- নানি তোমার বয়স হইছে, এখন সাইকেল চালানো বাদ দাও, বাড়ি বাড়ি যাওয়া বাদ দাও, রাস্তা-ঘাটে কখন কি ঘটে যায় কে জানে। তবে শুনেছি, নানি এসব বাদ দিতে পারেন না, তার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। সকাল হলেই তিনি কটা ভাত মুখে তুলে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যান। তারপর, আশপাশের গ্রামের সবার খোঁজখবর নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন। নানি যদি কখনো নিজে অসুস্থ থাকেন, তার খোঁজখবর নিতে নিজের বাড়িতে লোকজনের ঢল নামে। ভেলাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জানান, জহিরন বেওয়া নিজেকে সবসময় হাসি-খুশি রাখেন আর গ্রামবাসীকেও আনন্দ দিয়ে হাসি-খুশি রাখেন। তাই জহিরন বেওয়া গ্রামের সবার কাছে জনপ্রিয়, হয়ে উঠেছেন সবার নানি, লালমনিরহাট তথা বাংলার নানি। আমরা তাকে বাংলা নানি বলে সম্বোধন করি আর এতে তিনি বেশ খুশি থাকেন। য়