ঝরে যাওয়া অভিবাসী স্বপ্নগুলো

কে করবে তার সঙ্গে হওয়া এমন অবিচারের বিচার? হবে কি ওই দালালের কোনো উপযুক্ত শাস্তি? এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত বহু নারী সৌদিআরব থেকে দেশে ফিরেছে নির্যাতনের শিকার হয়ে। এরপর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এসেছেন আরও কয়েকজন। অনেকেই ফিরেছেন লাশ হয়ে

প্রকাশ | ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

জাকিয়া সুলতানা
মাত্র পাঁচ বছর স্বামীর সংসার করতে পেরেছিল নূরজাহান। পাঁচ বছরের মাথায় স্বামী চলে গেল পরপাড়ে। চোখে-মুখে ঘোর অন্ধকার নেমে এলো ওর। কী করবে সে দুটি ছেলেমেয়েকে নিয়ে। কীভাবে মানুষ করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কিন্তু তাই বলে তো বসে থাকলে চলবে না। একটা কিছু তো করতে হবে। নইলে বাচ্চা দুটোর মুখে আহার জুটবে কীভাবে। তাই বাজারে দোকানে দোকানে পানি দেয়া শুরু করল। তারপর এক চাচার বুদ্ধিতে চা-সিগারেটের দোকান। মোটামুটি ভালোই চলছিল। একদিন চায়ের দোকানে এক লোক এসে বলল তুমি এত কষ্ট করছ, তার চেয়ে কয়েক হাজার টাকা খরচ করলেই মাসে তুমি ভালো টাকা ইনকাম করতে পারবা। কীভাবে? নূরজাহান জানতে চাইল। সৌদিআরব মহিলা শ্রমিক নিচ্ছে বাসা-বাড়িতে কাজ করতে। ওখানে গেলে মাসে অন্তত ১৫ থেকে বিশ হাজার টাকা মাসে ইনকাম করতে পারবা। দুই বছর থেকে আসতে পারলে তোমার অন্তত ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা ক্যাশ থাকবে। এরপর তা দিয়ে ভালো কিছু করতে পারবে। নূরজাহান বেগম এবার নড়েচড়ে বসল। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। ভাবল কথা মন্দ নয়, তবে কত টাকা লাগতে পারে জানতে চাইলে লোকটি বলল ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা লাগবে। তবে আপাতত ১০-১৫ হাজার টাকা দাও কাগজপত্র রেডি হলে বাকিটা দিও। নূরজাহান বেগম মনে মনে স্বপ্নের জাল বোনা শুরু করে দিয়েছে। সে ভাবে সারাটি জীবন শুধু তো কষ্ট করেই গেলাম। দেখি না ভাগ্যে কী আছে! ভাগ্যের পরীক্ষায় একটু হাত বাড়াই না। তাই লোকটির কথামত নূরজাহান বেগমের কিছু টাকা জমানো ছিল তার সঙ্গে হাঁস-মুরগি, ছাগল বিক্রি করে দালালের হাতে তুলে দিল। আরও দিল দুই কপি ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি। ১৫ দিনের মধ্যে নূরজাহান বেগমের কাগজপত্র রেডি হয়ে এলো। আর কয়েকটি দিন পড়েই ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে সে উড়োজাহাজে চেপে বসল সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে। নূরজাহানকে ফিরে আসতে হলো নিজ দেশে। স্বপ্ন পূরণ করে নয়, তার সর্বস্ব খুইয়ে। নির্যাতনের ছোবলে ততদিনে তার ভালো থাকার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সে এখন মানসিক এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। কে করবে তার সঙ্গে হওয়া এমন অবিচারের বিচার? হবে কি ওই দালালের কোনো উপযুক্ত শাস্তি? এমন প্রশ্ন আজ শত শত নূরজাহানের। ওরা আমার দেশের সহজ-সরল প্রকৃতির নারী। ওরা কেউ স্বামী পরিত্যক্তা, কেউবা অতি দারিদ্র্যের কশাঘাতে পোড় খেতে খেতে ঘুরে দাঁড়াতে চেয়েছিল। কি ছিল ওদের অপরাধ? কেন ওদের জীবনে জেনেশুনে এমন অন্ধকার নামিয়ে আনল একটি গোষ্ঠী? কিন্তু এমন প্রশ্নে সবাই নীরব। ওরা কেউ কফিনবন্দি হয়ে আসছে লাশ হয়ে, কেউবা আসছে আধমরা হয়ে। কিন্তু হাজারো অঘটনের মধ্যে ওদের আকুতিগুলো ম্স্নান হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। হয়তো এক সময় সবাই ভুলে যাবে মর্জিনা-নূরজাহানদের কথা। শুধু ভুলবে না ওদের পরিবার, আপনজনেরা। যতদিন তারা বেঁচে থাকবে চোখের পানি ফেলবে। নূরজাহানের মতো এখনো অনেক নারী খবরের শিরোনাম হচ্ছে সৌদি আরবে নির্যাতনের বর্ণনা নিয়ে। তেমনি এক তরুণী মৌলভীবাজারের। তাকে বাসার কাজের কথা বলে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। একটি কক্ষে আটকিয়ে কীভাবে তাকে দলবেঁধে নির্যাতন করা হতো তা পড়লে শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে ওঠে। মেয়েটির সমস্ত শরীরে পোড়া দাগ। এমন নির্যাতন সভ্য সমাজে মেনে নেয়া যায় না। এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৫০ নারী সৌদিআরব থেকে দেশে ফিরেছে নির্যাতনের শিকার হয়ে। এরপর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এসেছেন আরও কয়েকজন। অনেকেই ফিরেছেন লাশ হয়ে। আর সে তথ্যের উপর ভিত্তি করে এখন বিভিন্ন্ন সংগঠন বেশ সরব রয়েছে। এর প্রতিকার হওয়া উচিত। আশা রাখব সরকার আমার দেশের নারীদের এমন নির্যাতনের বিচারে অবশ্যই সোচ্চার হবে।