যে ইতিহাস বীরত্বের, চেতনার, জয়গানের

পাকিস্তানিদের ঘায়েল করার জন্য সুপারি গাছের উপরে ঊঠে দুরবিন হাতে তার চোখ জোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে গান বোর্ডে পাক-হানাদাররা কোন পথে এগিয়ে আসতেছে তাদের দিকে। চোখে পড়ল পাক-বাহিনীর একটি গানবোর্ড তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারামন সুরুত করে নেমে পড়ল গাছ থেকে, নেমেই মুক্তিযোদ্ধারের ইশারা করল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে। নিজেও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র চালাতে শুরু করল। শত্রম্নরা তার এই উপস্থিত বুদ্ধির কারণে পরাস্ত হতে বাধ্য হলো।

প্রকাশ | ২১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

চেমন আরা কবি,গল্পকার ও ভাষাসৈনিক
মুক্তিযুদ্ধ শুরু ও শেষ হয়েছে অনেক আগে। দেশ এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। অসংখ্য নারীদের প্রশংসনীয় কর্মোদ্যম সারা পৃথিবীকে অবাক করে দিচ্ছে। তাদের অবাক করা কর্মকান্ড ও সফলতার ফলস্বরূপ গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত নারী সমাজের ক্ষমতায়নের পথ সম্প্রসারিত করে দিয়েছে। নারী যে এখন গৃহবন্দি প্রাণী নয় আর বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনীও নয় তা লোকসমাজে তারকা জ্যোতির মতো আলো দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বদরবারে। 'নারী ও পুরুষ একে অপরের ভূষণ' সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের এই অমিয় বাণী যে নারীদের জীবনকে ইসলামের শুরু থেকে মহিমান্বিত করেছে। আমাদের মহাগ্রন্থ কোরআনের পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে নারীজাতিকে নানাভাবে নন্দিত করা হয়েছে। তাতেই আমরা বুঝতে পারি নারী জীবনের শুরু থেকে মহান মর্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং তার প্রমাণও আমরা পাই ইসলামী যুগে আব্বাসীয় যুগে এবং মোগল আমলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আস্তে আস্তে আমাদের নারীসমাজ এই প্রশংসনীয় মহান মর্যাদা থেকে বিচু্যত হয়। কোরআনে স্পষ্টত বলা আছে-নারী ও পুরুষ উভয়েই সমান। কাজেই নারী ও পুরুষ উভয়কে নিজ নিজ কর্ম ক্ষেত্রে ভালো কাজ করতে হবে। পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে নিজের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যত ভালো ও মঙ্গলজনক কাজ করে যেতে পারবে। তাতেই শুভ এবং সুন্দরের অভিযাত্রী হবে। কিন্তু বহুদিন দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের পুরুষশাসিত সমাজ, অশিক্ষায়-কুসংস্কার এবং একশ্রেণির বর্ণবাদী হিন্দু মনমানসিকতার কারণে ব্রিটিশ আমলের শেষের দিক থেকে বাঙালি মুসলমানদের জীবনে অনেক অধঃপতন নেমে আসে। প্রকৃত জ্ঞান ও শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। নারীদের সমান অধিকার পালনের কোনো সুযোগ দেয়নি। লেখাপড়ায়, জ্ঞান-গরিমায় মুসলিম মেয়েরা ছিল বিশেষ করে অবহেলিত আমাদের এই দেশে। অল্পকিছু কুলীন অভিজাত শ্রেণিতে দেখা যায় কয়েকজন মেয়ে অদম্য উৎসাহ নিয়ে এবং পারিবারিক পরিবেশের বদৌলতে নিজেদের বিকশিত করার সুযোগ পেয়ে এই দেশের নারী জাগরণের পথকে সুগম করেছে। তারই ফলে আজকের বাংলাদেশে নারীদের জীবনে বিজয়ের মহতী উৎসব। মুসলমান এই নারীদের সূচনা লক্ষ্য করা যায় পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে। কিন্তু খুব ধীরে ধীরে। তাও ছিল শহরকেন্দ্রিক এবং একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রথম ১৯৫২ সালে প্রতিবাদী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এগিয়ে আসে পরে গোটা বাংলাদেশের মেয়েরা ১৯৭১ সাল স্বাধীনতার দীপ্য চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে যেভাবে দুঃখ, দারিদ্র্য, বিপত্তি, পরিবার ও সমাজের নানা রকমের বেড়াজাল ডিঙিয়ে নিরস্ত্র, নিঃসহায় অবস্থায় অসীম সাহসিকতায় স্বাধীনতাকে সফল করার লক্ষ্যে পাক-হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অজানা এক আনন্দ মঞ্জিলের দিকে সম্পূর্ণ এগিয়ে গিয়েছিল এখন ভাবতে অবাক লাগে এই শ্রেণির হাজার হাজার শিশু, কিশোরী, যুবতি, নারীদের কথা। যদিও এই অজানা বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত নারীগোষ্ঠীকে কোনোকালে আজ পর্যন্ত অনেকেই জানি না। কিন্তু শিকার করতেই হয় এই দুঃসাহসী নারীদের অসীম সাহসিকতার কারণেই (পুরুষদের কথা বাদ দিয়ে বলছি) বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মানচিত্র মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে সম্প্রতি স্থান করে নিয়েছে। খরস্রোতা নদীর মতো বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাতে প্রবাহিত করার পিছনের সমগ্র নারীসমাজের অবদান থাকলেও কিছু কিছু নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উগ্র পৈশাচিকতাকে উপেক্ষা করে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল তাদের কথা খুব কমই আমরা সভা-সমিতিতে উচ্চারণ করি। তাদের প্রতি যে আমাদের অপরিশোধ্য কত ঋণ তা স্বীকার করি তো না-ই আবার মনেও রাখি না। তেমন একটি বীর সাহসী কিশোরী মেয়ের কথা অনেক অনেক বছর পরে হৃদয় মথিত আবেগে, শঙ্কিত, বিনম্র, ভক্তি ও প্রশংসায় বলতে চাই। যারা এই সাহসিকতা নারীর কথা জানি না, জানার চেষ্টাও করি না তাদের জানার জন্য আমার এই কলম ধরা। উপরে নারীদের সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছি। এখন এমন একটি কিশোরী নারীর কথা বলব মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল চৌদ্দ। বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলা শংকর মাধবপুর ইউনিয়নে। ১৯৭১ সালে পাক-হানাদার বাহিনী যখন রাজধানী ঢাকায় হায়েনার মতো বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছিল তখন মানুষ দিশাহারা ও বাস্তুহারা হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় চারদিক পাগলের মতো নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছোটাছুটি করছিল অজানার পথে ধাবিত হচ্ছিল সেই পথেরই একজন এই কিশোরী মেয়ে তারামন। কিছুদিন সে ও তার পরিবার নিজ গ্রাম থেকে অন্যত্র সরে গিয়ে পাশের গ্রামে অস্থায়ীভাবে সহযোগিতা ও সহানুভূতির আড়ালে নিজেদের ঠাঁই করে নেয়। এই সময় অভুক্ত কিছু মুক্তিযোদ্ধারা সংগোপনে রান্না করার জন্য এই মেয়ের তলস্নাশে ছিল। ঠিক এমন সময় পেয়ে গেল তারামনকে। সে অত্যন্ত খুশিমনে এবং এটা দায়িত্ব মনে করে অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রান্নার ভার কাঁধে তুলে নেয়। তারামনকে এই দায়িত্বের ভার দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরই একজন, নাম-মুহিব হাবিলদার। তারামনের মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে। এই ভূমিকা পালনে আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাহায্য ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলো আজিজ মাস্টার। কিছুদিন পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে কিশোরী তারামনের মধ্যেও সংগ্রামের স্পৃহা জেগে ওঠে। যাদের রান্না করত তাদের সম্মতিতে এবং অনুপ্রেরণায় তারামন বিবিকে যেতে হলো কোদালকাঠির দশঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে প্রথমে সে কাজ করত বাসন পরিষ্কার, রান্না ও অস্ত্র পরিষ্কার। পিতৃহীন এই মেয়ের সংসার ছিল ভারী। ভাইবোন ছিল সাতজন। এদের সব চিন্তা মাথায় রেখেও উপরি এই সব দায়িত্বের স্থান থেকে বিচ্ছুত হয়নি। ধর্ম বাবা এবং সেই আশ্রয় দাতা মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালানোর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়। রাইফেল চালানো ভীষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হওয়ায় শেষে তাকে স্টেন গান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কর্ম যন্ত্রণায় কিশোরী এই নারী মা ভাইবোনের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেও হয়ে ওঠে একজন লড়াকু সৈনিক। তার জীবন পরিক্রমা এগোতে থাকে সংগ্রামের মধ্যদিয়ে। বাংলাদেশ মুক্ত করার স্বপ্নে। রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ীর মতো গাছের ডালে ডালে, পথে-প্রান্তরে নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানোর সময় হলেও সে কিন্তু তার মধ্যে একটি কঠিন দায়িত্বের ব্রত নিয়ে ছিল। লাবণ্য ভরা মুখে নবীন কিশোরী সবুজ-শ্যামল গ্রামে দশজন কিশোরীর ভান করে গ-ছে বসে থাকতো ঠিকই কিন্তু তার চোখ থাকতো হানাদারদের গতিবিধির ওপর। মাঝেমধ্যে পাগলির অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। মুখে কালি দিয়ে উপুর হয়ে গড়াতে গড়াতে একেবারেই পাক হানাদারদের কাছে চলে যেত। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে শক্রদের অবস্থান, অস্ত্রের গোডাউন, কোথায় গিয়ে অস্ত্র চালাতে হবে এই সব তথ্য অসীম সাহস বুকে ধরে সংগ্রহ করে আনত। তারপর সুযোগ বুঝে পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু করত অপারেশন। একদিন ঘটে গেল একটি মজার ঘটনা- মনে হলো রবীন্দ্রনাথের মৃন্ময়ী যেন এখানে কিশোরী তারামন বিবি হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। কিন্তু তারামন বিবি গ্রামের দুর্দান্ত প্রকৃতির পাড়া বেড়ানো সাধারণ গ্রামীণ মেয়ে নয়। দেশ বাঁচানোর সংগ্রামে নানান ছলচাতুরির পারদর্শী একজন গ্রামীণ সাহসী কিশোরী। একদিন গ্রামের দশ পরিবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা খেতে বসেছে। এবার তার এক নতুন উদ্যোগ, পাকিস্তানিদের ঘায়েল করার জন্য সুপারি গাছের উপরে ঊঠে দূরবীণ হাতে তার চোখ জোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে গান বোর্ডে পাক-হানাদাররা কোন পথে এগিয়ে আসতেছে তাদের দিকে। চোখে পড়ল পাক-বাহিনীর একটি গানবোর্ড তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারামন সুরুত করে নেমে পড়ল গাছ থেকে, নেমেই মুক্তিযোদ্ধারের ইশারা করল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে। নিজেও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে অস্ত্র চালাতে শুরু করল। শত্রম্নরা তার এই উপস্থিত বুদ্ধির কারণে পরাস্ত হতে বাধ্য হলো। শুধু একবার নয়, কয়েকবারই সে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অনেক সময় প্রতিবন্ধী বেশে পাক-বাহিনীর সামনে নানান ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করে সংবাদ সংগ্রহ করেছে। মাঝেমধ্যে বোবা হয়ে তাদের কোনো কথারই উত্তর দেয়নি। মাঝেমধ্যে একনাগাড়ে কাঁদতে কাঁদতে পাক-বাহিনীদের বেসামাল করে দিত। হঠাৎ করে এই পাড়ে হানাদার বাহিনীর আসার আভাস পেলে ফুরুৎ করে নদী সাঁতরিয়ে ওপারে চলে যেত। দুঃসাহসী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীদের এমনভাবে বোকা বানিয়ে তারামন বিবি বাঙালি মহিলাদের জীবনকে যেভাবে গৌরবান্বিত করেছে এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। শিক্ষাহীন, বিদ্যাহীন, দুঃখ-দারিদ্র্যে লালিত এই কিশোরী মেয়ের যে কর্ম আমরা দেখতে পাই ইতিহাসে তার উদাহরণ বিরল। তার বাবার নাম ছিল আব্দুল সোবহান। এবং মায়ের নাম কুলছুম বিবি। স্বামীর নাম আব্দুল মজিদ। তিনি এক ছেলে ও একমেয়ের গর্বিত মা। যুদ্ধ শেষে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সরকার এই মহীয়সী নারীকে সাহসিকতা, মুদ্ধিমত্তা ও বীরত্বের জন্য 'বীর-প্রতিক' ভূষিত করেছেন। আমরা বাঙালি জাতি অনেক ক্ষেত্রে মহৎ মহৎ কাজের জন্য মহৎ গুণীদের সম্মান দেখানোর জন্য সম্মাননা দেওয়ার জন্য অনেক অনেক কষ্ট, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই গুণী মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৯৫ সালে। তিনি নিজে এসে ও তার গৌরবগাথা সরকারের সামনে এসে প্রকাশ করেননি। ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের একজন গবেষক তাকে খুঁজে বের করেন। পরে সরকার জানতে পেরে অনেক জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তার হাতে সনদ প্রণয়ন করেন। এই মহীয়সী নারীর কিছু কথা লিখতে পেরে ৮৫ বছর বয়সে নিজেকে ধন্য মনে করছি। বাঙালি নারীদের মধ্যে এমন নারীদের উৎসরণ ঘটুক এই কামনা মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রার্থনা করি...