এক জয়িতার গল্প

বেগম রোকেয়া দিবসে টাঙ্গাইল জেলা পর্যায়ে জয়িতাদের সম্মাননা দেয়ার অনুষ্ঠানে মারুফা বলেন, 'আজ আমাকে আপনারা যে সম্মাননা দিচ্ছেন, আসলে এই সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য আমার মা'। ওই দিন মঞ্চে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মা-মেয়ের হাতে জেলার সেরা জয়িতার ক্রেস্ট তুলে দেন। মারুফা বলেন টাকার অভাবে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি। এক বছর লেখাপড়া বন্ধ ছিল। পরের বছর মা তার কানের একজোড়া দুল বিক্রি করে অতিকষ্টে ঘাটাইল এসই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন করে আনেন। বিসিএস চূড়ান্ত ফলাফলে পুলিশ প্রশাসন (এএসপি) পদে টিকে গেলে মা খুশিতে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তায় যাকে পান তাকেই বলতে থাকেন 'আমার মেয়ে এএসপি হয়েছে'

প্রকাশ | ১১ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মু. জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
টাঙ্গাইল জেলার সেরা জয়িতা মারুফা নাজনীন
একজন মারুফা নাজনীন, টাঙ্গাইল জেলার সেরা জয়িতা। পেশায় পুলিশ অফিসার, লক্ষ্ণীপুর জেলার রামগাতি সার্কেলের এএসপি হিসেবে কর্মরত। এই জয়িতা হয়ে ওঠার পিছনে মায়ের একজোড়া কানের দুল বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এ বছর বেগম রোকেয়া দিবসে টাঙ্গাইল জেলাপর্যায়ে জয়িতাদের সম্মাননা দেয়ার অনুষ্ঠানে মারুফা বলেন, 'আজ আমাকে আপনারা যে সম্মাননা দিচ্ছেন, আসলে এই সম্মাননা পাওয়ার যোগ্য আমার মা'। ওই দিন মঞ্চে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মা-মেয়ের হাতে জেলার সেরা জয়িতার ক্রেস্ট তুলে দেন। মারুফা নাজনীন এলাকায় পরিচিত লিপি নামে। বাবা আখতার হোসেন, মাতা ফরিদা ইয়াছমিন। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল পৌরসভার শহিদ আব্দুর সাত্তার রোডে তাদের বাড়ি। খুব সাধারণ পরিবারের এক মেয়ে। তিন ভাই-বোনের সংসারে মারুফা সবার বড়। তার বাবার আরও একটি সংসার ছিল। তাই ঠিকমতো ভরণপোষণ করতেন না। ২-৩ মাস পর বাবা একবার তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, আবার কোনো সময় আসতেন না। বাবা ২-৩ দিন পর পর ২০০ টাকা করে পাঠাতেন। তা দিয়ে ছোট বোনের এক প্যাকেট দুধ আর এক কেজি চিনি কিনলে এককেজি চাল কেনার মতো টাকা থাকত না। যেখানে চাল কেনার টাকাই নেই সেখানে বাজার কেনার কথাটা সব সময় প্রশ্নই থেকে যায়। মারুফা নাজনীন বলেন, 'মা ভাত রান্না করত আর মা-মেয়ে দুজনে লবণ-পানি দিয়ে খেয়ে দিন পার করতাম। আমার পড়ালেখার জন্য বাবা কখনো ভাবত না। নবম শ্রেণিতে উঠে পড়াশোনা একেবারে প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। টাকার অভাবে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারিনি। এক বছর লেখাপড়া বন্ধ ছিল। পরের বছর মা তার কানের একজোড়া দুল বিক্রি করে অতিকষ্টে ঘাটাইল এসই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় বোর্ড থেকে রেজিস্ট্রেশন করে আনেন। দশম শ্রেণিতে ক্লাস শুরু করলাম। মা ঠিকমতো খাতা-কলম কিনে দিতে পারতেন না। একটা ছাড়া দুটা জামা আমার ছিল না।' তিনি বলেন, 'মা সেলাইয়ের কাজ জানতেন। সে সময় একজন লোকের কাছ থেকে ১৫০০ টাকা ধার করে কিস্তিতে একটা সেলাই মেশিন কেনেন। এরপর রান্নাসহ ছোট দুই ভাই-বোনের দেখাশোনার কাজ আমার ওপর এসে পড়ে। মা শুরুতে বাজার করার ব্যাগ সেলাই করতেন। প্রতি ব্যাগে ২০ পয়সা করে পেতেন। তারপর এলাকায় পরিচিত হলে কাপড় সেলাই করা শুরু করেন। এভাবেই চলতে থাকে আমাদের সংসার' যোগ করেন মারুফা। মারুফা বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি রাত জেগে মায়ের কাজে সাহায্য করতাম। এরই মধ্যে এসএসসির টেস্ট পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করি। পরে স্কুলের ইংরেজি স্যার 'খাজা ফেরদৌস' বাসায় এসে আমাকে এক রিম খাতা এবং দশটা কলম উপহার দেন। সেই সময় স্যার বলেছিলেন, 'তোর কাছে একটাই চাওয়া, শুধু ভালো একটা রেজাল্ট এনে দিবি'; স্যার সবসময় আমার খোঁজ নিতেন। আমি সারা জীবন স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ। এসএসসি পাস করার পর ঘাটাইল জিবিজি কলেজে ভর্তি হই। কলেজে বেতন দিতে হতো না। স্যাররা আমাকে ফ্রিতে প্রাইভেট পড়াতেন। এভাবেই এসএসসি এবং এইচএসসির সময়কাল পার করি। মারুফা বলেন, 'অভাবের সংসার, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমার হবে না তাই ঘাটাইলে বিএসসি করব- এমন সিদ্ধান্ত নিলাম। হঠাৎ একদিন মা বললেন, 'তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়াবো'। আমি বললাম ফরম কিনে দিতে পারবে না কীভাবে পরীক্ষা দেব। যাক মায়ের কথামত শুরু হলো ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। চান্স পেয়ে গেলোম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহে। পড়ালেখার পাশাপাশি প্রাইভেট পড়াতাম। এরই মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে শিক্ষা ঋণ নিই। অনার্স শেষবর্ষে এসে আমার বিয়ে হয়। মাস্টার্স পড়ার খরচ স্বামী চালিয়েছেন। সেরা জয়িতা স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'মাস্টার্স শেষ করে ৮ মাস একটি এনজিওতে চাকরি করি। এরই মধ্যে ফার্ম স্ট্রাকচারের উপর থিসিস শেষ করি। পরে ফেনী সিটি কলেজে কৃষি বিষয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি। চাকরিরত অবস্থায় ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিই। বিসিএস চূড়ান্ত ফলাফলে পুলিশ প্রশাসন (এএসপি) পদে টিকে যাই। এ খবর শোনার পর সেদিন আনন্দে অনেক কেঁদেছিলাম। আর আমার মা খুশিতে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে থাকেন। দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তায় যাকে পান তাকেই বলতে থাকেন 'আমার মেয়ে এএসপি হয়েছে' আর কাঁদতে থাকেন। আমি সবশেষে একটি কথাই বলতে চাই আমার মায়ের মতো মা যেন সব ছেলেমেয়েদের হয়।' সংসারজীবনে মারুফা, ব্যবসায়ী স্বামী মুজিবুল কাইয়ুম আরমান আর একমাত্র সন্তান শায়ানকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন বলে জানান। মা ফরিদা ইয়াছমিন বলেন, 'আলস্নাহতালার আমাদের প্রতি দয়া ছিল। আমার পরিশ্রম আজ সার্থক'। সংগ্রামী এই জননীর অন্য এক মেয়ে নুসরাত জাহান ইভা পড়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথমবর্ষে ও একমাত্র ছেলে ইফতেখাইরুল হাসান পড়ে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে অনার্স প্রথমবর্ষে।