সময়ের আবর্তে আমার বাংলা ভাষা

আমরা উদ্যোগ নিয়েছি বললে যা বুঝছি, আর যদি বলি হঁ্যা আমরা ইনিশিয়েটিভ নিয়েছি তাহলেও তাই বুঝছি, শুধু খেয়াল রাখতে হচ্ছে কার সঙ্গে কথা বলছি! তাতে আমার বাংলা ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে না; অপমানিতও হচ্ছে না। কিন্তু বাংলা ভাষায়, ভুল উচ্চারণ, ভুল শব্দযোগে বাংলা ভাষার অপমান হচ্ছে সেটা খেয়াল রাখা জরুরি। না হলে আমরা অশ্রাব্য কথনে ভাসতে ভাসতে একটি অসভ্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী হয়ে বেঁচে থাকব। ফিরে আসতে হবে প্রমিত বাংলা উচ্চারণে, শ্রম্নতিমধুর ভাষা ব্যবহারে

প্রকাশ | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মুশফিকা মোশাররফ শিলু বর্তমান সময়ে আমরা সবসময়ই ঘরে বাইরে, কিংবা কোনো পোশাকি অনুষ্ঠানেও আঞ্চলিক ভাষা, ভূলভাল শব্দ চয়ন আর উল্টাপাল্টা উচ্চারণে কথাবার্তা বলে থাকি; একটু খেয়াল করলেই অনুভব করা যায়; সবসময়, সবখানে আঞ্চলিকতায় শ্রম্নতিমধুর নয়, বোধগম্যও নয়, ভুল উচ্চারণ তো কথার মানেই বদলে দেয়; আর শব্দ চয়নে যত্নশীল না হলে সেই কথাবার্তা শুনতে রুচি হবে না এটাই ঠিক! একদিন বন্ধুরা মিলে পাবলিক লাইব্রেরিতে একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখতে গেছি, তো আমার বন্ধুরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রেমময় জুটিতে বাধা পড়েছে! তারা তাদের প্রেম উপলক্ষে বন্ধুদের ট্রিট দিচ্ছে, সিনেমায় যাচ্ছে, বইমেলায় হাত ধরে হাঁটছে! কিন্তু আমার তখন ডানাভাঙা অবস্থা, সদ্য ছেঁকা খেয়েছি, বেশ কয়েকটি ছেঁকায় আমার বেহাল দশা! আমি কাউকে পছন্দ করেই জানতে পারি যে সে অন্যের হয়ে গেছে! অথচ দুদিন আগেও তারা আমার জন্য প্রাণপাত করতে দ্বিধা করেনি! যাই হোক এরকম মনের অবস্থা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সেই প্রামাণ্যচিত্র দেখতে গিয়ে দেখলাম একজন সুপুরুষ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটা আমার একজন বন্ধুর পাড়াতো বন্ধু। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না, আমার হার্টবিট মিস হয়ে গেছে দু'একটা! ছেলেটা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, ঈর্শনীয় উচ্চতা তার! গায়ের রং ফর্সাই বলা যায়, সাদা পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট, কোহলাপুরে স্যান্ডেল পায়ে, পায়ের গড়ন অকল্পনীয় সুন্দর! ছেলেটির বলিষ্ঠ হাতের কব্জিতে একটা রোলেক্স ঘড়ি; চুল আঁচড়ানোর ধরনটা সেই রকম হৃদয়কাড়া! আমি আমার বান্ধবীকুলকে কুনুই দিয়ে খোঁচা মেরে অনুরোধ করেছিলাম, শোন তোরা তো জোড়া বেঁধেছিস, এরদিকে আর চোখ দিস না পিস্নজ! আমার কথা একটু ভাব দয়া করে! ওরা আমার কথায় কর্ণপাত করল না, ছেলেটিকে ওদেরও ভালো লেগেছে এবং হ্যাংলামো করতেও শুরু করেছে। আমি অবশ্য দমে গেলাম না। দু'চোখ ভরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। এর মধ্যে আমরা সবাই নিজেদের নাম বলে পরিচিত হয়ে নিলাম। এবার আমাদের সঙ্গে তার পরিচিত হওয়ার পালা; সে বলল, 'আফনেরা এই হানে এট্টু খাড়ান, আমি ভিত্তেতথন আইতাছি, আসলে আফনগো লাইগাই আরো কয়েকটা চেয়ার লাগবো, হেগুলো ভিতরে দিয়াই আইতাসি' আমার গা গুলাচ্ছিল, বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল! এরকম সুদর্শন একটা ছেলে এই ভাষায় কথা বলছে! তার আঞ্চলিকতা থাকতেই পারে, কিন্তু এমন একটা পরিবেশে সে তো পারতো শ্রম্নতিমধুর ভাষায় কথা বলতে! আমার বন্ধুরা সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি সেদিন প্রামাণ্যচিত্র না দেখেই বাসায় ফিরে এসেছিলাম। তার মুখ নিসৃত অশ্রাব্য ভাষা আমার স্বপ্ন, ভালো লাগা, এক নিমেষে, এক ফুৎকারে হাওয়ায় মিলিয়ে দিল। আর একদিন, আমি একটা কর্মশালায় অংশগ্রহণ করছিলাম; অনেকেই তাদের বক্তব্য দিচ্ছিলেন মঞ্চে উঠে। দু'একজনের বক্তব্য এত ভালো লাগছিল, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম! কিন্তু হঠাৎই শুনতে পাচ্ছি, 'বাংলাদেশে এখন ঠাডা (বজ্রপাত) এক পোকার দুযযোগ হয়ে উটেছে, এই ঠাডার হাত তেকে বাছতে হলে, সেই ফুরান (পুরনো) দিনের মতোই বাড়ির কোণার মইদ্দে লোআর দন্ড বসাইতে হবে' আঞ্চলিতকার সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু একটা বিশেষ পরিবেশে, বিশেষ উদ্দেশ্যে কিছু বলতে গেলে আঞ্চলিতকা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়! সেই বক্তব্য যেন সবাই বুঝতে পারে সেটা খেয়াল রাখা দরকার না? আবার মুখের ভাষা শ্রম্নতিমধুর হওয়া দরকার! আজকাল ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেয়ার সময় খুবই অপ্রমিত ভাষায় কথা বলে, যেমন, 'ওই ল যাই লাবুর দোখন থেকে কিসু খাইয়া আসিগা' 'তরা যারে আমার যাইতে ইসসা করতাসেনা' কেমন লাগছে এই কথোপকথন? বিরক্তিকর না?। আচ্ছা যদি এ কথাগুলো এমন করে বলা হতো, 'চল আমরা লাবু মিয়ার দোকান থেকে কিছু খেয়ে আসি' এটি কি বোধগম্য নয়? শুনতে ভালো লাগছে না? এই ভাষায় কথা বলতে কি বন্ধুদের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না? আমরা বুঝতে পারছি না এই তথাকথিত 'বলিত ভাষা' জাতির ভাষার কত বড় সর্বনাশ করছে! আমি যখন উচ্চারণটাই এমন স্ট উচ্চারণ নকরছি তখন লিখছিও কিন্তু সেরকমই যেমন; 'মেডাম, বাশার সাহেব কে তো কবর দিয়া আসছি' কবর মানে খবর দিয়ে এসেছে কিন্তু উচ্চারণ বিভ্রাটে খবর শব্দটা কবর হয়ে গেল, ম্যাডাম শব্দটা হয়ে গেল মেডাম! প্রমিত অপ্রমিতের পরেও আছে ভুলভাল উচ্চারণ! আমি দেখেছি কেউ বোর্ডে লিখছে, 'জাইগার দাম অনেক' জাইগা শব্দটা আসলে 'জায়গা' কিন্তু যেহেতু উচ্চারণে জায়গা শব্দটা হয়ে গেল জাইগা! মারাত্মক ভুল নয়? অনেকে আবার বলে থাকেন, 'উদ্দেগ নিতে হবে' আচ্ছা বলুনতো উদ্যোগ শব্দটার এমন নষ্ট ব্যবহার কি ঠিক? ভাষার এই অসহায় লুটোপুটি অবস্থা দেখার জন্যই কি ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য ভাষাসৈনিকরা প্রাণ দিয়েছিল? পৃথিবীতে এই বাংলা ভাষার জন্যই শুধু লড়াই হয়েছিল, আজ সে ভাষার এমন যথেচ্ছাচা- সহ্য হয়? এবার ইংরেজি শব্দের মরণদশার দু-একটি উদাহরণ দিচ্ছি, যেমন বস কাউকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে, 'আগামী কালকের মধ্যেই সব এক্টিবিটি গুলু আইডেনটি করে রাখবেন, যা মিটিনে উপস্থাপন করবেন' উচ্চারণের গুনে মিটিং শব্দটা সে লেখে গরঃরহ! সম্পূর্ণ ভুল নয়? ওফবহঃরঃু শব্দটা হয়ে গেল ওফবহঃর এসব ভুল এখন আর আমরা গায়ে মাখি না, অনেকেই বলে থাকেন, 'আরেহ এসব ভুল ধরার কি আছে, মানুষকে বোঝাতে পারলেই হলো' অদ্ভুত কথা না? আমরা অনেকেই বাংলা ভাষার সাথে ইংরেজি ভাষার মিশ্রণ সহ্য করতে পারি না; কঠোর সমালোচনা করি। কিন্তু বাংলার সঙ্গে ইংরেজির মিশ্রণে কিন্তু অনেক সময় বোঝাবুঝির অবস্থাটা ভালোই করে, যেমন- আমরা উদ্যোগ নিয়েছি বললে যা বুঝছি, আর যদি বলি হঁ্যা আমরা ইনিশিয়েটিভ নিয়েছি তাহলেও তাই বুঝছি, শুধু খেয়াল রাখতে হচ্ছে কার সঙ্গে কথা বলছি! তাতে আমার বাংলা ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে না; অপমানিতও হচ্ছে না। কিন্তু বাংলা ভাষায়, ভুল উচ্চারণ, ভুল শব্দযোগে বাংলা ভাষার অপমান হচ্ছে সেটা খেয়াল রাখা জরুরি। না হলে আমরা অশ্রাব্য কথনে ভাসতে ভাসতে একটি অসভ্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠী হয়ে বেঁচে থাকব। ফিরে আসতে হবে প্রমিত বাংলা উচ্চারণে, শ্রম্নতিমধুর ভাষা ব্যবহারে। লেখক: কথাসাহিত্যিক