আ মরি বাংলাভাষা

শিশুর ভাষার বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভ থেকেই। এ সময় সন্তান বাবা-মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় এবং শব্দ ভান্ডারে শব্দ সঞ্চয় করতে থাকে। সন্তান জন্মের পর তার অন্যান্য যত্নের পাশাপাশি ভাষার প্রতিও যত্ন নেওয়া উচিত। কেননা পরিবারই শিশুর শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। সুতরাং আমাদের শিশুদের শুদ্ধ বাংলা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর পর্ব বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত।

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মনিরা মিতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'আমার ছেলেবেলা' গল্পে লিখেছিলেন, সেজদাদা বলতেন 'আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন।' অলৌকিকভাবে যদি রবিঠাকুরের সেজদাদা বর্তমান সময়ে কিছু সময়ের জন্য বাংলাদেশে আসতেন জানি না তার অভিব্যক্তি কেমন হতো! 'আমার সন্তান তো বাংলা তেমন বলতে পারে না।'......এ ধরনের নকল অহংকার ঘিরে ধরেছে এখনকার বাবা-মায়েদের। শুদ্ধ বাংলা বলা বা লিখতে পারা তো দূরের কথা, সমাজে মানানসই বাংলাটাও বলতে পারে না বর্তমান প্রজন্ম। ভাষা নিয়ে আমরা যখন চর্চা করতে বসেছি তখন কি একবারও ভাবছি আমাদের সন্তানরা কী শিখছে? কতটুকু শিখেছে? সুন্দর করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলাও বড় সম্মানের, যোগ্যাতার। মাতৃভাষা না জানলে একটা শূণ্যতা থেকেই যাবে। নিজের মন থেকে মনের ভাব প্রকাশের সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে। জন্মের পর থেকেই শিশুরা হাত-পা নাড়িয়ে হাসি-কান্নার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর ভাষার বিকাশ শুরু হয় মাতৃগর্ভ থেকেই। এ সময় সন্তান বাবা-মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় এবং শব্দ ভান্ডারে শব্দ সঞ্চয় করতে থাকে। সন্তান জন্মের পর তার অন্যান্য যত্নের পাশাপাশি ভাষার প্রতি ও যত্ন নেওয়া উচিত। কেননা পরিবারই শিশুর শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। সুতরাং আমাদের শিশুদের শুদ্ধ বাংলা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানোর পর্ব বাড়ি থেকেই শুরু করা উচিত। শিশুকে বাংলা ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে মা। মায়েরা প্রতিদিন শিশুকে বাংলা ছড়া, গল্প, কবিতা পড়ে শোনাতে পারেন। সুতরাং বাংলা ভাষায় কথা বলা ও লেখার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ কারার চেষ্টা হোক বাড়িতেই, মায়ের কাছেই। শিশুকে নিজ দেশ ও নিজ ভাষার প্রতি আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গাগুলোতে নিয়ে যাওয়া উচিত। যেমন- শহিদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, জাদুঘর, বইমেলা ইত্যাদি। এ ছাড়া মনে রাখতে হবে শিশুকে যথাযথ ভাষা শিক্ষা দিতে হলে অভিভাবকে শিশুর সঙ্গে স্পষ্ট ভাষায় ও শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে হবে। গল্পের বই শিশুর জন্য বরাবরই আকর্ষণের বিষয়। শুদ্ধ উচ্চারণ শেখাতে বই পড়ে শোনানো খুব কার্যকর একটি মাধ্যম। মায়েদের উচিত শিশুকে গল্প, কবিতাসহ বিভিন্ন ধরনের শিশুতোষ বই পড়ে শোনান। শিশু সেগুলো মনোযোগসহকারে শুনবে ও মনে গেঁথে রাখবে। শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় আঞ্চলিকতা পরিহার করা উচিত। কারণ শিশুর সামনে যা বলা হয়, তা-ই তারা শিখে ফেলে। সুতরাং কখনোই বাজে শব্দ ব্যবহার করবেন না। মনে রাখতে হবে, শিশুর ৪-৫ বছর বয়সের মধ্যেই ভাষার মৌলিক কাঠামো গড়ে ওঠে। মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারাটা বাচ্চার অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়। অতএব, সন্তানের স্বার্থেই তাকে সঠিকভাবে মাতৃভাষা শিক্ষা দিতে হবে। গর্ভস্থ শিশু চেনে তার মাকে, তার বাবাকে আর চেনে মাতৃভাষাকে। মা যে ভাষায় কথা বলে, সেটাই তার কাছে ভাবপ্রকাশের অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। পরে সাহিত্য সৃষ্টিতে কিংবা বিজ্ঞানের রহস্য উন্মোচনে মাতৃভাষা হবে ওর কাঁকড়ে থাকার একমাত্র অবলম্বন। মাতৃভাষা শিক্ষাই ওর মধ্যে উন্নত রুচিবোধ, জাতীয় ঐহিত্য সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলবে। বাংলাভাষা নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। কিন্তু বিদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে বাঙালির বাঙালিআনা। বর্তমানে ভারতীয় চ্যানেলের অনুষ্ঠান, নাটক দেখার আগ্রহ-ই ভাবিয়ে তুলছে সচেতন মহলকে। কার্টুন চ্যানেল, খেলার চ্যানেল, সিরিয়াল চ্যানেলে যে সব অনুষ্ঠান দেখানো হয় সেগুলোকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলাই ভালো। বই পড়া, সেলাই করা, গান শোনার যুগ এখন আর নেই। শিশুদের জীবনে খেলাধুলা, গল্প শোনা, বই পড়া থেকে কার্টুন দেখা-কম্পিউটারে গেমস খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের শুদ্ধ বাংলায় কথা না বলতে পারার জন্য প্রকৃত দায়ী কে? একটি শিশুকে তার সমাজ কিংবা পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন প্রধানত তার মা ও পরিবার। যদি পরিবার এ দায়িত্ব পালন করতে না পারে, তবে সে বড় হয়ে শিকড়কে ভুলে যাবে। সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, ভাষার দক্ষতা চারটি-শোনা, বলা, পড়া, লেখা। এসময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন 'যে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য প্রাণ দিয়েছে এ দেশের সূর্য সন্তানরা-সে ভাষা কতটা আয়ত্ত করতে পারছে এ প্রজন্ম?' আজ বাংলাভাষা বিভিন্নভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছে। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমাদের ভাষার যে মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, তা বাঙালির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এখন আর মিলছে না। পরিশেষে, বাংলাভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। সন্তাদের শেখাতে হবে সঠিক ও শুদ্ধ বাংলাভাষা, পরিবেশের প্রতিবন্ধকতা ও অনাদর্শের বেড়াজাল থেকে শিশুকে মুক্ত রেখে কীভাবে সুন্দর ও আদর্শময় জীবন গঠন ও পরিচালনা করা যায় সেদিকে খেয়াল রেখেই মা তার সন্তানকে গড়ে তুলবেন। শিক্ষা দেবেন এবং উত্তম সম্পদে পরিণত করবেন। আগামীদিনের জাতির কান্ডারি বানাবেন। তৈরি করবেন সুশিক্ষিত আলোকিত মানুষ।