বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার আলো ছড়াতে একজন বৃন্দা রানী

'শিক্ষার কোনো বয়স নেই, এটা যে কোনো সময়ই করা যায়'- চলিস্নশ বছরের বৃন্দা রানী এমনই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভাসংলগ্ন নাচনাপাড়া এলাকার বাসিন্দা এ বৃন্দা রানী। বর্তমানে মা-মেয়ে একই কলেজে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক তার। ফলে পরিবারের নানান ঝক্কি-ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও চালিয়ে আসছেন তার পড়াশোনা।
চঞ্চল সাহা, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
বৃন্দা রানী

'আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি দেবো' নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেই উক্তিটি উপলব্ধি করে মনে করি 'শিক্ষার কোনো বয়স নেই, এটা যে কোনো সময়ই করা যায়'- চলিস্নশ বছরের বৃন্দা রানী এমনই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌরসভা সংলগ্ন নাচনাপাড়া এলাকার বাসিন্দা এ বৃন্দা রানী। বর্তমানে মা-মেয়ে একই কলেজে ডিগ্রিতে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনার প্রতি প্রবল ঝোঁক তার। ফলে পরিবারের নানান ঝক্কি-ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও চালিয়ে আসছেন তার পড়াশোনা।

২০১৫ সালে খেপুপাড়া মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে কারিগরি শাখা থেকে এসএসসি পাস করে কলাপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে মানবিক শাখায় ভর্তি হন বৃন্দা রানী। এর আগে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে জেএসসি পাস করে নবম শ্রেণিতে এসে খেপুপাড়া সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

সহপাঠীদের কাছ থেকে জানা গেছে, কলেজের পাঠদানে সে প্রায় নিয়মিত অংশ নেন। সহপাঠীদের সঙ্গেও তার দারুণ সখ্য রয়েছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠ চুকিয়ে সবার সঙ্গে পড়াশোনার খুটিনাটি নিয়ে আলাপ করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কোনো সময় কলেজে আসতে না পারলে সেটা অন্যদের কাছ থেকে জেনে ঘাটতিটা পুষিয়ে নেন। এভাবেই চলছে বৃন্দা রানীর কলেজজীবন।

কথা প্রসঙ্গে বৃন্দা রানী জানালেন, তার এক ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে কিশোর চন্দ্র শীল বর্তমানে পটুয়াখালী সরকারি কলেজে দর্শন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ পর্বের ছাত্র। মেঝো মেয়ে মুক্তা রানী এ বছর কলাপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছেন। সবার ছোট মেয়ে তমা দেবী খেপুপাড়া মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে।

এই বয়সে পড়াশোনার প্রতি এমন আগ্রহের কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে ছোট সময়ে ভালো সম্বন্ধ পেয়ে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন। তখন আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না। তারপরেও বাবার দিকে চেয়ে বিয়েতে মত দিই। এ কারণে আমার লেখাপড়াটা আর আগায়নি। এজন্য মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ছিল। আর এটাও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি ঠিকই আবার পড়াশোনা করব। কম করে হলেও বিএ পাসটা করব। এর মধ্যে সংসারের অভাবের কারণে আমি কিছুদিন কেয়ারের পুষ্টি প্রকল্পে চাকরিও করেছি। সেখানে আমার বড় কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে ফিল্ড ভিজিট করতে এলে অনেক সময় জানতে চাইত, আমরা কে কে এসএসসি পাস করেছি। যারা পাস করা ছিল তারা ঠিকই উঠে দাঁড়াতো। আমি ওই সময় দাঁড়াতে পারতাম না। তখন নিজেকে অনেক ছোট মনে হতো। এটাও আমার পড়াশোনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার বড় একটা কারণ। বলতে পারেন সেই জেদ থেকে আবার এ বয়সে এসে পড়াশোনা শুরু করেছি।

সহপাঠী আর শিক্ষকদের সম্পর্কে বৃন্দা রানী বললেন, 'সহপাঠীরা আমাকে আদর করে 'খালা' ডাকে। ওরা তো আমার মেয়ের মতোই। সন্তানতুল্য সহপাঠীরা আমাকে দারুণ ভালোবাসে। আমি শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হলেই ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে। আমিও ওদের মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। তাছাড়া শিক্ষকরাও আমার প্রতি খুব খেয়াল করেন। আমার পাঠদানে বিশেষ গুরুত্ব দেন।' সহপাঠী ইসরাত জাহান সৌদিয়া, শামিমা আক্তার বলে, 'ওই খালা যেদিন ক্লাসে আসেন না, সেদিন আমাদেরও ভালো লাগে না। তাছাড়া তাকে দেখে আমরাও অনুপ্রাণিত হয়েছি।'

কলাপাড়া মহিলা ডিগ্রি কলেজের ইতিহাস বিষয়ের প্রভাষক নেছারউদ্দিন আহম্মেদ টিপু বলেন, 'বৃন্দা রানী এ যুগের নারী শিক্ষার জন্য এক অনন্য উদাহরণ। সবচেয়ে বড় কথা হলো সে নিজে পড়ছে, আবার সন্তানদেরও পড়াচ্ছে। আমরা তার পড়াশোনার জন্য সাধ্যমতো সহায়তা করছি।'

তবে দুঃখের কথা হলো বৃন্দা রানী স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কলাপাড়া পৌর শহর লাগোয়া নাচনাপাড়া গ্রামে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাহির পাশের ঢালে ছোট্ট একটি খুপরি ঘরে তারা বসবাস করছে। বসত ঘরটির অবস্থাও জরাজীর্ণ। এর ওপর অভাব-অনটন তো লেগেই আছে। স্বামী নির্মল চন্দ্র শীল মাস্টাররোলে খেপুপাড়া পোস্ট অফিসের অধীনে শারিকখালী ইউনিয়নের চাউলাপাড়া শাখা পোস্ট অফিসে রানার পদে চাকরি করেন। মাস শেষে সামান্য টাকা সম্মানী পান। যার ফলে পরিবারের পাঁচ সদস্যের ভরণপোষণ মেটাতে বৃন্দা রানীকেও ঘাম ঝরাতে হয়। বাড়তি আয়ের জন্য ঘরে বসে তিনি 'কাগজের ঠোঙ্গা' বানিয়ে বাজারের দোকানে বিক্রি করেন। এজন্য সপ্তাহে দুদিন তাকে ক্লাস কামাই দিতে হয়। কাগজের ঠোঙ্গা বানানো থেকে তার মাসে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়। সবমিলিয়ে তাদের পরিবারের আয় এখনকার বাজারে যৎসামান্য। স্বামী-স্ত্রী দুজনের ওই আয় আর ধারকর্য করে চলছে কোনোমতে তাদের জীবন। এর মধ্যে নিজের পড়াশোনা, অন্যদিকে তিনটি ছেলেমেয়ের পড়াশোনা নিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বৃন্দা রানীর পরিবার। ফিরে আসার সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৃন্দা রানী বললেন, 'শত কষ্ট হলেও আমি থেমে যাব না। পড়াশোনা আর জীবনযুদ্ধে আমি একদিন জয়ী হবই।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<88540 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1