বাল্যবিবাহ সমাজের জন্য অভিশাপ

বাল্যবিবাহ আর নেই- কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমরা প্রত্যেকেই এমন অসংখ্য বাল্যবিবাহের নীরব সাক্ষী। আপনজনের অসম্মানের ভয়ে কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদী হতে চেয়েও পারি না। বাল্যবিবাহ যে সমাজের জন্য একটা বিষফোঁড়া এবং অভিশাপও তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। সমাজকে এই অভিশাপ মুক্ত করার জন্য শুধু নারীদের সচেতন হলেই চলবে না। সচেতন হতে হবে সরকার, পিতা-মাতা, পরিবার এবং পুরুষ সমাজকে।

প্রকাশ | ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

রুকাইয়া নাজনীন
মানবজীবনের প্রাথমিক শিক্ষাগুলো স্বভাবতই পরিবার থেকে অর্জন করার কথা। কিন্তু বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে শতকরা কতজন মানুষ পরিবার থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে থাকেন? সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের চারপাশের মানুষ, পরিবারগুলোকে খেয়াল করলেই এ প্রশ্নের সদুত্তর মিলবে। আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষ পারিবারিক শিক্ষা বলতে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনকে বুঝে থাকেন। অথচ জীবন বাস্তবতা, নানামুখী অভিজ্ঞতা, দাম্পত্য জীবনের সম্ভাব্য সমস্যা আর সমাধানমূলক শিক্ষাও যে পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে পড়ে তা অনেকেই মানতে রাজি থাকেন না। যার নেতিবাচক প্রভাব হতে পারে মারাত্মক! অনেকেই হয়তো বলবেন- এগুলোও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যেই পড়ে। আমাদের সমাজে নামাজ আর আরবিতে কোরআন শিক্ষা ছাড়া কন্যা সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা খুব একটা দেয়া হয় বলে আমার জানা নেই। যথাযথ ভাবে বাংলা অর্থসহ কোরআন শিক্ষা এবং সহীহ হাদিস চর্চা করানো হলে সেখানে গোঁড়ামী, অসচেতনা, বিশৃঙ্খলতার জায়গা কমে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে সন্তানকে এসব শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি পিতামাতা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকেও তা অর্জন করতে হবে। অন্যথায় বিশৃঙ্খলতা ও গোঁড়ামীর অবসান ঘটবে না। দ্বন্‌দ্ব ও সংঘাত লেগেই থাকবে। মূলত জ্ঞানচর্চা ব্যতীত চিন্ত-চেতনা, মেধা ও মননের প্রসারতা অসম্ভব এবং সেই জ্ঞান কেবল ধর্মীয় জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও চলবে না; প্রতিটি মানুষকে অর্জন করতে হবে বিশ্বসাহিত্যের পাঠ, নিতে হবে জীবনমুখী শিক্ষা। বর্তমানে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের প্রচলন আগের তুলনায় কম। বাল্যবিবাহ আর নেই- কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। আমরা প্রত্যেকেই এমন অসংখ্য বাল্যবিবাহের নীরব সাক্ষী। আপনজনের অসম্মানের ভয়ে কেউ কেউ হয়তো প্রতিবাদী হতে চেয়েও পারি না। বাল্যবিবাহ যে সমাজের জন্য একটা বিষফোঁড়া এবং অভিশাপও তার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। সমাজকে এই অভিশাপ মুক্ত করার জন্য শুধু নারীদের সচেতন হলেই চলবে না। সচেতন হতে হবে সরকার, পিতা মাতা, পরিবার এবং পুরুষ সমাজকে। পুরুষ কিংবা নারী উভয়কেই ভাবতে হবে-বিবাহের সাথে কেবল জৈবিক বিষয়টি জড়িত নয়, বরং বৈবাহিক সম্পর্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের পুরো জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে নির্ধারণ করে থাকে। কাজেই প্রত্যেকের ভেবে চিন্তে জীবনসঙ্গি নির্ধারণ করা জরুরি। কিছু কিছু ভুল শুধরানোর সুযোগ খুব কম থাকে। আবার কিছু কিছু ভুল সম্পূর্ণ জীবনটাকেই নষ্ট করে দিতে পারে। মূলত জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। বিয়ের পর পরই গর্ভধারণকে আমি যৌক্তিক মনে করি না। দুটি ভিন্ন পরিবেশ থেকে উঠে আসা দুটি ভিন্ন মানুষ যখন একসাথে জীবন পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তখন তাদের উভয়কেই অনেক কিছু ছাড় দিয়ে চলতে হয়। মুখে বললেই কিংবা অনেক সময় চেষ্টা করলেই ছাড় দেওয়া যায় না। ছাড় দেওয়ার আগে একে অন্যকে ভালোভাবে বুঝতে হয়। কাউকে ভালোভাবে বুঝতে হলে তার কথা শুনতে হয়, বন্ধুর মতো মিশতে হয়, তার কাছে নিজেকে নিরাপদ জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তাকে সময় দিতে হয়, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে যতটা সম্ভব গুরুত্ব দিতে হয়। তারপর তার শারীরিক ও মানসিক চাহিদা অনুযায়ী ছাড় দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। অন্যথায় অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে দেওয়ার মতো ব্যাপার ঘটতে পারে। এই যে পরস্পরকে গ্রহণ করার বিষয়, মেনে নেয়ার বিষয়- এগুলো সময়সাপেক্ষ বিষয়। হুটহাট করে সুন্দর সামঞ্জস্যপূর্ণ, ভারসাম্যপূর্ণ শ্রদ্ধার সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একটি পবিত্র ভালোবাসার বন্ধন। বৈবাহিক বন্ধনটা কতটা পবিত্র ও সুন্দর সেটা বুঝে উঠতেও সময়ের প্রয়োজন। অন্যথায় বৈবাহিক সম্পর্ক কেবলই জৈবিকতার বৃত্তে আটকে যাবে, তা মায়া-মমতা-ভালোবাসাকে প্রকৃত অর্থে ধারণ করতে সক্ষম হবে না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরির আগেই যদি সন্তান নেয়া হয়, সে সন্তান বিভিন্ন দিক দিয়ে অবহেলার শিকার হতে পারে। আর পিতা মাতার মাঝে মনোমালিন্য, দাম্পত্য কলোহ সন্তানের জন্য কতটা নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব পরিবারের সন্তানরা মানসিকভাবে অসুস্থতার শিকার হতে পারে, ভুল বা অন্যায় পথে পা বাড়াতে পারে, মানসিক শান্তির আশায় মাদকাসক্ত হতে পারে, সমাজ বা আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া তারা যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে উঠবে, তখন সম্পর্কের প্রতি তাদের ভেতর একটা ভয় ও নেতিবাচক ধারণা কাজ করতে পারে, যা তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধা প্রদান করতে পারে, মানসিক শান্তি বিনষ্ট করতে পারে, জীবনের প্রতি তিক্ততারও জন্ম দিতে পারে। অনেক সময় তারা আত্মহত্যার মতো জঘন্য ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তও নিতে পারে। মূলত পিতামাতা সন্তানের জন্য এমন একটি ভরসা, স্নেহ, মায়া মমতা, ভালোবাসা ও আদর্শের জায়গা যার বিকল্প আজও পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি, কোনোদিন হবে বলেও আমি বিশ্বাস করি না।