রোকেয়া চান যুদ্ধাহতের স্বীকৃতি

প্রকাশ | ২১ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সবুজ শর্মা শাকিল, সীতাকুন্ড
১৯৭১ সাল। সীতাকুন্ড ভাটিয়ারী ইউনিয়নের জাহানাবাদ ও হাসনাবাদসহ একাধিক গ্রাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলবে বলে খবর এলে সবাই মহাসড়কের পূর্বে পাহাড়ে আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি শুরু করেন। ওই সময় আত্মরক্ষার্থে স্বজনদের সঙ্গে পাহাড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন সাত বছর বয়সি রোকেয়া। সীতাকুন্ডের জাহানাবাদ গ্রামের বাসিন্দা নুর আহমেদের মেয়ে রোকেয়া তখন জানতো না যুদ্ধ কী! কেন নিরস্ত্র বাঙালিদের পাকিস্তানি সেনারা নিয়ে গণহাতে হত্যা করছে। এসব কিছু না জানলেও মা-বাবার সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে চলছিল সে। কিন্তু তাতেও রক্ষা হয়নি। বাড়ি থেকে বের হয়ে ২০০ গজ দূর স্থানীয় মুন্সিবাড়ির সামনে ১০ ডিসেম্বর দুপুরে পাকবাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে উড়ে যায় তার বাম পা। রোকেয়াকে তার পিতা নুর আহমদ ও আত্মীয় ইসলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করায়। হাসপাতালে ৫ মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর রোকেয়া ডান পা নিয়ে বাড়ি ফেরে সে। যুদ্ধের ৮ মাস পর তার বাবাও মারা যায়। মা সালমা খাতুনকে নিয়ে স্থানীয়দের সাহায্য সহযোগিতায় অর্ধহারে অনাহারে চলে তার সংসার। দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘ এত বছর পেরিয়ে গেলেও মেলেনি যুদ্ধাহত হওয়ার এই স্বীকৃতি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা সাহায্যের আশ্বাস দিলেও মেলেনি কোনো সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য। স্বাধীনতার পর পিতৃহারা সংসারে পঙ্গুত্বের কারণে আমি অনেকটা বোঝাই রূপান্তরিত হই। পঙ্গু হওয়ার কারণে আমাকে এলাকার কেউ বিয়ে করতে চাননি। যুদ্ধ পরবর্তীতে আমার পঙ্গুত্বকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে না দেখে এলাকার অনেক মানুষ উপহাস করতেন। এতে অনেক সময় কষ্ট পেলেও সুদিনের স্বপ্নে নিজেকে সামলে নিতাম। রোকেয়া আরও বলেন, এলাকার মানুষের উপহাস, হাসি, তামাশা করলেও দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আমার একাকিত্বের অবসান ঘটে। আমার সবকিছু জানার পরও আমাকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেন সিলেটের আবদুস সামাদ। স্বামীর সংসারে সুখের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি কোহিনূর ও সাবিনা নামে আমার ২ কন্যার জন্ম হয়। দুই মেয়েকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার পর ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেন আমার স্বামী। কিন্তু ২০০৭ সালে আমার স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃতু্যর বছর দুয়েকের মাথায় আমার মেয়ে সাবিনার স্বামী সেলিমকে রাতে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা হত্যা করে। স্বামীর অকাল মৃতু্যর পর সাবিনা তার দুই শিশুকন্যা নুসরাত জাহান তিশা (১৩) ও ইসরাত জাহান ইসাকে (১১) নিয়ে পঙ্গু মায়ের সংসারে ওঠে। অশ্রম্নভেজা কণ্ঠে পঙ্গু রোকেয়া জানান, আমার নিজস্ব কোনো বাড়ি ভিটা নেই। ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্ককারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে আমার বাড়ি-ঘর পানিতে ভেসে গেছে। সেই সঙ্গে যুদ্ধের পরে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসার কাগজপত্রও ভেসে গেছে। মাদাম বিবির হাট কনফিডেন্স সিমেন্ট কারখানার পশ্চিমে ইছামতি খালের পাড়ে অন্য জনের ভূমিতে কুঁড়েঘরে এখনো বসবাস করছি। গত দুই বছর আগ থেকে পাচ্ছেন বিধবা ভাতা। বছর দুয়েক আগে থেকে তার ডান পাও অবস হয়ে গেছে। অসহায় এই পঙ্গু রোকেয়া কি কখনো পাবে তার এই ত্যাগের স্বীকৃতি। পাবে কি মাথা গোঁজার জন্য এক টুকরো ভূমি? সত্তর বছর বয়সি স্থানীয় বাসিন্দা রাজা মিয়া ও সোলাইমান জানান, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে পা হারান রোকেয়া। সেই থেকে অনেক কষ্টে দিন কাটছে তার। মুক্তিযুদ্ধে পা হারিয়ে পঙ্গু হওয়া যুদ্ধাহত রোকেয়াকে সরকারি স্বীকৃতি দিতে তারা প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।