বেড়ানো

পানাম নগরে একদিন

পানাম নগরীর বিভিন্ন দালানের নির্মাণশৈলীতে ও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ব্যবসায়ী আর জমিদারদের বসবাসের এই নগরীর প্রতিটি দালান অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

সুমন্ত গুপ্ত
কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে সবসময় সবচেয়ে বেশি উৎসাহ থাকে আমার। গন্তব্য স্থানে কীভাবে যাওয়া, কি কি দেখতে পাওয়া যাবে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সব কিছুই জানার চেষ্টা করি আমি। ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে যাকে সাথে নেবো তাকে আগের থেকেই গুঁতোতে থাকি সে যেন গন্তব্যে যাত্রার দিন তৈরি থাকে। তবে একটা বিষয় প্রমাণিত যে নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি যে লাফায় সেই শেষ পর্যন্ত যায় না। যাই হোক অনেক দিন ধরে শুধু পস্ন্যানই করছি কিন্তু যাওয়া আর হচ্ছে না প্রাচীনকালের সমৃদ্ধ নগর সুবর্ণ গ্রাম। যার বর্তমান নাম সোনারগাঁও। ঈসা খাঁর আমলের বাংলার রাজধানী ছিল পানাম নগর। বড় নগর, খাস নগর, পানাম নগর-প্রাচীন সোনারগাঁওর এই তিন নগরের মধ্যে পানাম ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। এখানে কয়েক শতাব্দী পুরনো অনেক ভবন রয়েছে, যা বাংলার বার ভূঁইয়াদের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঈসা খাঁর যাতায়াত ছিল এই নগরীতে। সেই সময়টাতেই অর্থাৎ সুলতানি আমলে বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করে। পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীপথে বিলেত থেকে আসতো বিলাতি থানকাপড়, দেশ থেকে যেত মসলিন। ওই সময়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর ফলে ইউরোপীয় অনুপ্রেরণায় নতুন ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠে পানাম নগরী। ইংরেজরা এখানে নীলের বাণিজ্যকেন্দ্র খুলে বসে। সেই সঙ্গে মসলিনের বাজার দখল করে নেয় নীল বাণিজ্য। একসময় ধনী হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল এখানে এবং ছিল মুসলিমদের জমজমাট ব্যবসা। প্রাচীন সেই নগরীতে তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই, আছে শুধু ঘুরে দেখার মতো ঐতিহাসিক বাড়ি-ঘর। শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা চরিত্রের পর আমরা রওনা দিলাম পানাম নগরের দিকে। আমাদের চার চাকার গাড়ি চলছে তার নিজস্ব ছন্দে আর আমি বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি। ঘণ্টা পার হলো, ঢাকা থেকে সোনারগাঁ যাচ্ছি। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না। আরও কিছুক্ষণ পর অবশেষে মোগড়া পাড়ায় এসে থামলাম। সেখান থেকে স্বল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পানাম সিটিতে। গাড়ি থেকে নেমেই চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। মনে হলো ভুল কোনো শতাব্দীতে ঢুকে পড়েছি। শুধু একটা মাত্র দালান হলেও কথা ছিল। কিন্তু এ যে চোখের সামনে পঞ্চদশ শতকের এক হারানো রাজ্য, চারশো বছরের পুরনো পানাম নগরী। আমি, চিন্টু, আর সানন্দা মিলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। পানাম নগরীতে ঢোকার মুখে কথা হলো ওখানকার কর্তব্যরত আনসার গার্ডের সঙ্গে। উনি জানালেন, এই নগরীর পুরোটাই খাল দিয়ে বেষ্টিত যার নাম পঙ্খিরাজ খাল। এই খাল পূর্বদিকে মেনিখালী নদ হয়ে মেঘনা নদীতে এসে মিশেছে। নগরীর পূর্বে মেঘনা আর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা। এই পথেই বিলেত থেকে আসত বিলাতি থান কাপড় আর দেশ থেকে যেত মসলিন। আর আছে বিশাল সুরক্ষিত গেট যা সন্ধ্যা হলেই বন্ধ হয়ে যেত। এখনো সন্ধ্যার আগ পর্যন্তই এটা নগরী দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। আমরা পদব্রজে এগিয়ে যেতে লাগলাম সম্মুখ পানে। পানাম নগরে ঢুকেই চোখে পড়লো একটি সরু রাস্তার ধারে সারি সারি পুরনো দালান। কোনোটা দোতলা কোনোটা আবার একতলা। আমরা ভেতরে প্রবেশের একটু পরেই শুরু হলো মুষলধারায় বর্ষণ। কোনো উপায়ান্ত না দেখে একটি পুরনো ভবনের নিচে অবস্থান নিলাম। এদিকে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই ছবি তুলতে লাগলো। বৃষ্টিস্নাত ভবনগুলো দেখতে আরও সুন্দর লাগছিল। আমিও বৃষ্টি ভিজে ছবি তুললাম। হেঁটে গেলাম সামনের দিকে বাড়িগুলোর স্থাপত্য নিদর্শন দেখে বোঝা যায় এখানে ধনী বণিক শ্রেণির লোকরা বসবাস করতেন। বাড়িগুলোতে মোঘল ও গ্রিক স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণ দেখা যায় এবং প্রতিটি বাড়ির কারুকাজ স্বতন্ত্র। কারুকাজ, রঙের ব্যবহার এবং নির্মাণ কৌশলের দিক থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশলের প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে। প্রায় প্রতিটি বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই লোহার তৈরি ব্র্যাকেট। জানালায় ব্যবহার করা হয়েছে লোহার গ্রিল এবং ঘরে বায়ু চলাচলের জন্য ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা হয়েছে। সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য হলো বাড়িগুলোতে কাস্ট আয়রনের নিখুঁত কাজ আছে, এবং ইউরোপে ব্যবহৃত কাস্ট আয়রনের কাজের সঙ্গে এই কাজের অনেক মিল লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া মেঝেতে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ লক্ষণীয়। নগরীর ভিতরে আবাসিক ভবন ছাড়া আছে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, মঠ, গোসল খানা, নাচঘর, পান্থশালা, চিত্রশালা, খাজাঞ্চিখানা, দরবারকক্ষ, গুপ্তপথ, বিচারালয়, পুরনো জাদুঘর। এদিকে পথ চলতে চলতে সবারই পেটে লেগেছে। সেই কখন পেটে দানাপানি পড়েছে কিন্তু কি করা শেষমেশ পানাম নগরীর ভেতরেই একটি দোকান পাওয়া গেল। দোকানে প্রবেশের পর সবার মন খারাপ। চিপস আর কোল্ড ড্রিংক ছাড়া খাবার কিছুই নাই। যা-ও আছে তা আবার চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে চিপস অধিক দামে কিনে খেতে হলো। চিপস খেয়ে পেটের রাম-রাবনের যুদ্ধ সাময়িক বিরতিতে গেল আমরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। পানাম নগরীর বিভিন্ন দালানের নির্মাণশৈলীতে ও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ব্যবসায়ী আর জমিদারদের বসবাসের এই নগরীর প্রতিটি দালান অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত। খুব খেয়াল করে দেখলাম পানাম নগরীকে চিরে দুই ভাগ করে চলে যাওয়া পাঁচ মিটার প্রশস্ত ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দুই পাশে একতলা, দোতলা ও তিনতলা মিলিয়ে রয়েছে প্রায় ৫২টি ভবন। সড়কের উত্তর পাশে আছে ৩১টি ভবন এবং দক্ষিণ পাশে আছে ২১টি ভবন। ওয়ার্ল্ড মনুমেন্ট ফান্ড ২০০৬ সালে পানাম নগরকে বিশ্বের ধ্বংস প্রায় ১০০টি ঐতিহাসিক স্থাপনার তালিকায় স্থান দেয়। আমরা পদব্রজে কেবল রাস্তার দুই ধারের বাড়িগুলো দেখেই আমরা সন্তুষ্ট হইনি। আমরা চেয়েছিলাম সব জায়গাটা ভালো করে দেখতে। স্থাপত্যগুলোর পেছন দিকটায় গিয়ে দেখি চমৎকার বাতাসে জলাশয়ের ওপারে ফুলগাছগুলো এক মোহনীয়রূপে দেখা দিয়েছিল আমাদের মাঝে।