বাঙালির ঐতিহ্য

কাচারি ঘর

প্রকাশ | ১৭ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আখতার হোসেন খান হারিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের বাঙালিদের ঐতিহ্য কাছারি ঘর। যা গ্রামের অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবারে যা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বাড়ির বাহির আঙিনায় অতিথি, মুসাফির, বাড়ির ছেলে, ছাত্র ও জায়গিরদের থাকার এই ঘরটি কাছারি ঘর বা বাংলা ঘর নামে সমধিক পরিচিত ছিল। বর্তমানে ড্রয়িং রুমের সাজ-সজ্জার মাধ্যমে কোনো অভিজাত পরিবারের আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ঝাড়বাতি, সোফাসেট, অ্যাকিউরিয়াম, কারুশিল্প, রুচিশীল কোনো ছবি দিয়ে মনোমুগ্ধকরভাবে সাজানো হয় অতিথি শালা বা রেস্ট রুম। এক সময়ে গৃহস্থ বাড়ির একমাত্র আভিজাত্যের প্রতীকই ছিল বাড়ির বাহির আঙিনার বাংলো ঘর। মানুষের কাছে যা কাছারি ঘর নামে পরিচিত ছিল। এই কাছারি ঘরের চৌকির ওপর থাকত বাড়ির অবিবাহিত ছেলে বা ছাত্ররা। আর মেহমান বা অতিথিরা এলে চৌকির ওপরে থাকতে দেয়া হতো। মাটিতে একঢালা খড় বা বাঁশের দারি (পাটি) বিছিয়ে বিছানা করে থাকত বারোমাসি কামলারা (রাখাল)। গড় গড় শব্দে তারা হুক্কা টানত আর ধোঁয়া ছাড়ত। প্রতি রাতেই পাড়ার সব রাখাল বড় কোনো কাছারি ঘরে মিলিত হয়ে গানের আসর বসতো। গান করত পলস্নীগীতি, ভাটিয়ালী, রূপবান, আলোমতি, সাগরভাসা, বেহুলা লখিন্দরের পালা। প্রায় প্রতিটি রাতে কাছারি ঘরওয়ালা বাড়িতে আসত অনাত্মীয়- অচেনা কোনো মুসাফির। ভেতর বাড়ি থেকে শোনা যেত কোনো অচেনা মুসাফিরদের কণ্ঠ : 'বাইত্তে কেরা আছুন গো? কাছে এলে বলত : থাক্‌পার জাগা দেন নাগবো। অনেক রাইত অইছে, নদী পার অয়ন যাবো না।' এই নদীর কারণেই বাংলাদেশের বাঙালিরা হয়ে উঠেছিল- অতিথি পরায়ণ। আরবের মানুষও অতিথি পরায়ণ হয়েছিল, শুধু মরুভূমির কারণে। রাতের বেলা বালির ঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে তারা আশ্রয় নিত কোনো না কোনো বাড়িতে। যত রাতেই আসুক অতিথিদের না খেয়ে শুতে দিত না বাড়িওয়ালারা। মজার ব্যাপার হলো- এ সব অতিথিরা রাতের অন্ধকার থাকতেই উঠে চলে যেত, তবে বাড়ির কোনো কিছু হারায়নি কোনো দিন। কাছারি ঘরের সামনে ছিল বারান্দা। কোনোটির সামনে ছিল গাড়িবারান্দা। বারান্দায় সব সময় একটি হেলনা (হেলান দেয়ার) বেঞ্চ থাকত। ক্লান্ত পথিকরা এখানে বসে একটু জিড়িয়ে নিত। কখনো কখনো পান-তামাক (হুক্কা) খেয়ে যেত। রোজার দিনে পথিকদের ইফতারের জন্য কাছারি ঘরের সামনে বেতের ঢাকিতে (ঝুড়ি) মুড়ি-গুড় আর পানির কলসি রাখা হতো। এখন আর কোনো বাড়িতে কাছারি ঘর নেই। বারোমাসি রাখালের প্রচলন নেই, নেই রাখালি গান। গরুর কাঁচা দুধের দই করে না কেউ। হয় না গরুর গোয়াল ঘরে রাখাল ভাত খাওয়া। বিলুপ্ত হচ্ছে কাছারি ঘর নামে খ্যাত বাহির বাড়ির বাংলো ঘরটি। এখন সেখানে জায়গা করে নিয়েছে ড্রয়িং রুম।