সন্দ্বীপের সবুজ চর

প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
সাজিদ মোহন সবুজ চর নামেই সবার কাছে পরিচিত এ চরটি। সন্দ্বীপের উত্তরে বামনী নদী ও পশ্চিমে মেঘনা নদীর মোহনাঘেঁষে আমানউলস্না, সন্তোষপুর, দীর্ঘাপাড়-তিনটি ইউনিয়নজুড়ে বিস্তৃত এ চর। উপকূলীয় বেড়িবাঁধের পর যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ চর। ছয়টি ঋতুতে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিলেও মূলত শীত ও বর্ষা দুই ঋতুতে সবুজ চর হাজির হয় তার সব সৌন্দর্য নিয়ে। বর্ষায় নদীতে পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে জোয়ারের পানিতে পস্নাবিত হয় চর। বিস্তীর্ণ চরজুড়ে তখন চাষ হয় রাজাশাইল ধান। প্রত্যেক জমির আল কেটে বসানো হয় মাছ ধরার চাঁই। জোয়ারের পানির সঙ্গে নদী থেকে উঠে আসে টেংরা, চিড়িং, কোরাল, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। ভাটার সময় পানি নেমে গেলে চাঁইয়ের ভেতর আটকা পড়ে মাছগুলো। শত শত চাঁই বসানো থাকে জমিগুলোতে। যেন ধান আর মাছ নিয়ে প্রাকৃতিক সমন্বিত চাষাবাদ। কয়েকটা জমি পরপর মাটি থেকে চার-পাঁচ ফুট উঁচুতে ছাউনি দেয়া মাচার মতো ঘর বানানো থাকে। সেখানেই রাত জেগে মাছ ধরে, চাঁই পাহারা দেয় স্থানীয় লোকজন। কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায় বড় বড় জলাশয়। সেখানে ফুটে থাকে রাশি রাশি শাপলা। শখের বসে শাপলা তোলে গ্রামের মেয়েরা। কেউ খোঁপায় গোঁজে, কেউ বিক্রি করে স্থানীয় বাজারে। জোয়ারের সময় গরু নিয়ে ঘরে ফিরতে দেখা যায় এসব বালিকাদের কাউকে কাউকে। শীতকালে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হয় সবুজ চর। বর্ষাকালের জল থই থই চরটাকে যেন আর চেনা যায় না তখন। শরতের শুরুতে আকাশে ভেসে বেড়ায় বাউন্ডুলে মেঘ। সবুজ চর থেকে সন্ধ্যার আকাশ দেখার এটাই উপযুক্ত সময়। সূর্য ডোবার পর আকাশের খোলা ক্যানভাসে নানান রঙে ছবি আঁকে প্রকৃতি। আকাশ পরিষ্কার থাকায় সন্দ্বীপের উত্তরে চরের শেষ প্রপ্রন্ত দাঁড়ালে পূর্বদিকে দেখা যায় চট্টগ্রামের পাহাড় আর উত্তরে নোয়াখালী। বেড়িবাঁধের উপরে এসে দাঁড়ালে চরের মাঝখানে বিচ্ছন্ন দ্বীপের মতো ছাড়া ছাড়া কতগুলো বাড়ি চোখে পড়ে। সন্ধ্যা নামলে ওসব বাড়ির ভেতর মিট মিট আলো জ্বলে। একবার মনে হয় তারা, একবার মনে হয় জোনাকি। হেমন্তে ধান কাটা শেষ হলে বিপুল বিরহ নিয়ে শূন্য পড়ে থাকে মাইলের পর মাইল। এ সময় বিস্তীর্ণ চরজুড়ে কোনো ফসল না থাকায় ছেড়ে দেয়া হয় ভেড়ার পাল। সারাদিন ঘাস খেয়ে রাখালসহ ওদের ঘরে ফেরার দৃশ্য বলে দেয় কাকে বলে গোধূলি সন্ধ্যা, কাকে বলে গড্ডলিকাপ্রবাহ। ভেড়াপালন স্থানীয় লোকজনের অন্যতম আয়ের উৎস। চরের কোথাও কোথাও দেখা যায় মহিষের পাল। নানান রকম পাখির আনাগোনা বেড়ে যায় এসময়। গুলতি হাতে নিয়ে বের হয় গ্রামের দসু্য ছেলেরা। চরের কিছু কিছু অংশে বেড়িবাঁধের ঢালে চাষ হয় মৌসুমী সবজি। বিকালে বেড়িবাঁধের সারি সারি খেজুর গাছে হাঁড়ি বসিয়ে দেয় গাছিরা। সূর্য লাল আবির ছড়িয়ে ডুব দেয় পশ্চিমের বঙ্গোপসাগরে। শীত জেঁকে উঠলে রসের গন্ধে ম-ম করে চরাচর। শুকনো নাড়া জ্বালিয়ে গল্পে মেতে ওঠে চরের মানুষ। কোথায় কোথাও রান্না হয় রসের পায়েস। শৌখিন ভ্রমণপিপাসুরা সন্দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসময় পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন নিয়ে ঘুরতে আসেন এখানে। অল্প দামে কিনতে পাওয়া যায় রাজহাঁস। স্কুল-কলেজ থেকে মাইক বাজিয়ে আসে পিকনিক বাস। ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে ওঠে চরের প্রত্যেকটি ধূলিকণা, ঘাস। মাঝে মাঝে অনেক বছর পর সাগরে সাতদিন সাঁতার কেটে একটা গাছের টুকরোকে আকড়ে ধরে কূলে এসে ভেড়ে অপরিচিত এক লোক।মাছে খাবলে খাওয়া শরীর।নাম বলতে পারেনা,ঠিকানা বলতে পারেনা।উৎসুক জনতার ভীড় জমে লোকটাকে ঘিরে।ঘন হয়ে আসে রাত।সে লোকের গল্প বছরের পর বছর ভেসে বেড়ায় সবুজ চরের বাতাসে।খুব নিরিবিলি একা একা কান পেতে থাকলে ফিসফিস সে গল্প শোনা যায় এখনও।