বে ড়া নো

আহসান মঞ্জিলে এক প্রহর

প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুলস্নাহ
বেলা গড়িয়ে দুপুর তখন। ঝিরঝির হিমেল হাওয়ার আনাগোনা ছিল আশপাশে। শীতের প্রকোপ ছিল না তেমনটা। নবাব আমলের স্থাপত্য দেখতে কদম বাড়ালাম আমরা দুজন। মূল ফটকের সামনে এসে থ খেয়ে গেলাম। প্রবেশ-টিকেটের জন্য লম্বা সারি। অগত্যা লাইনে দাঁড়ালাম। এরই ফাঁকে এক দাদার কাছ থেকে জেনে নিলাম ঐতিহ্যেঘেরা মঞ্জিলটির অজানা কিছু তথ্য। আহসান মঞ্জিলকে ঢাকা শহরের প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে মনে করা হয়। তৎকালীন নবাবদের হাতে এই ভবনেই প্রথম বৈদু্যতিক বাতি জ্বলে ওঠে। ভবনটির স্থাপত্যশৈলী পশ্চিমাদেরও সমানভাবে আকর্ষণ করে। লর্ড কার্জন ঢাকায় এলে এই ভবনেই থাকতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে আহসান মঞ্জিল বাংলাদেশ সরকারের জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত। ১৯৯২ সালে এই জাদুঘর জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। নবাবদের সময়ে ঢাকায় ফিল্টার করা পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়। একপর্যায়ে টিকেট হাতে পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। নজরে এলো মনোরম একটি রাস্তা। দুই পাশে যার হরেক রকমের ফুলগাছ। চোখে পড়ল মূল প্রাসাদ। যার পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি মাঠ। পাশেই ফুচকা, বেলুন, ঝাল-মুড়িওলাদের ভিড়। উত্তর-পূর্বে রয়েছে একটি ফুলের বাগান। প্রাসাদের দক্ষিণ পাশঘেঁষে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। আহসান মঞ্জিল দুটি অংশে বিভক্ত। পূর্বাংশের গম্বুজযুক্ত অংশকে বলা হয় প্রাসাদ ভবন বা রংমহল। পশ্চিমদিকের আবাসিক প্রকাষ্ঠাদি নিয়ে গঠিত ভবনকে বলা হয় অন্দরমহল। প্রাসাদ ভবনটি আবার দুটি অংশে বিভক্ত। মাঝখানে গোলাকার কক্ষের ওপর অষ্টকোণবিশিষ্ট উঁচু গম্বুজ। আমরা পা বাড়ালাম পূর্বাংশে। দোতলায় দেখতে পেলাম বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার, কাড্ররুম ও তিনটি অতিথিশালা। এরপর ছুটলাম পশ্চিমাংশে। এদিকটাতে দেখলাম নাচঘর ও কয়েকটি আবাসিক কক্ষ। আবাসিক কক্ষ দেখতে দেখতে সোজা দোতলা থেকে প্রাসাদের আঙিনায় নামার প্রশস্ত সিঁড়িতে পা রাখলাম। সব বয়সের দর্শনার্থীদের দেখলাম এখানে ছবি তোলায় ব্যস্ত। এবার এগোলাম নিচতলার পূর্বাংশে। ডাইনিং হল দিয়ে ঢুকে পশ্চিমাংশে বিলিয়ার্ড কক্ষ, দরবার হল ও কোষাগার হয়ে বেরুলাম। প্রাসাদ ভবনের উভয় তলায় উত্তর ও দক্ষিণে নজরে এলো সুপ্রশস্ত বারান্দা। সেগুলোতে হেঁটে হেঁটে ফটোশু্যটে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আহসান মঞ্জিলের ৩১টি কক্ষের ২৩টি কক্ষ বিভিন্ন প্রদর্শনীর জন্য। নয়টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। তোষাখানা কোকারিজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র এবং নওয়াব অ্যাস্টেটের পুরনো অফিস এডওয়ার্ড হাউস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। নাকের ডগায় পড়ল আহসান মঞ্জিল জাদুঘর। ২৩টি কক্ষে যার সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা ৪ হাজার ৭৭টি। যেখানে দেখা গেল নবাবী আমলের অনেক বিষয়। ঢাকার পুরনো স্থাপনাগুলোর মধ্যে আহসান মঞ্জিল অন্যতম। এ ভবনে থাকতেন ঢাকার নবাবরা। এখানে বসেই তারা জমিদারি পরিচালনা করতেন। ভবনটি নির্মাণ করেন নওয়াব আবদুল গণি। পুত্র খাজা আহসানুলস্নাহর নামে ভবনটির নামকরণ করেন। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কুমারটুলী এলাকায় এর অবস্থান। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আহসান মঞ্জিলের এই জায়গায় একটি রংমহল ছিল। যা নির্মাণ করেন তখনকার জমিদার শেখ এনায়েতউলস্নাহ। তার পুত্র মহলটি ফরাসি বণিকের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে খাজা আলিমুলস্নাহ ফরাসিদের কাছ থেকে আবার এটি কিনে নেন। তার ছেলে নওয়াব আবদুল গণি ১৮৫৯ সালে এখানে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ শুরু করেন। কাজটি শেষ হয় ১৮৭২ সালে। ১৮৯৭ সালের এক টর্নেডোতে ভবনটির অনেক ক্ষতি হলে নবাব আহসানুলস্নাহ তা সংস্কার করেন। ভবনটির ছাদে সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। আরও আছে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশপথ, ওপরে ওঠার সুন্দর সিঁড়ি। ১৯০৬ সালে এখানেই মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এসব প্রাক-ইতিহাস অবলোকন করতে করতে দোতলাবিশিষ্ট ভবনটির বারান্দা ও মেঝেতে চোখ আটকে গেল। যা তৈরি করা হয়েছে মার্বেল পাথর দিয়ে। আহসান মঞ্জিলের প্রতিটি কক্ষ অষ্টকোণবিশিষ্ট। ভবনটির ছাদ কাঠের তৈরি। প্রাসাদের ঠিক সামনের চমৎকার ফুলের বাগান ও সবুজ মাঠে পা রাখলাম। শেষমেশ ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির আবহ ছুঁয়ে ধীরে ধীরে ফেরার পথ ধরলাম।