শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায়

প্রকাশ | ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সুমন্ত গুপ্ত
সমকালীন শিল্পকলার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, প্রকৃতি ও মানবতাবাদের শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। বাংলাদেশের শিল্পচর্চা ও শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ এ মহীরুহের চিত্রকর্ম ও আনুষঙ্গিক বেশ কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। শিল্পীর জন্মস্থান জেলা শহর ময়মনসিংহের ব্রক্ষপুত্র নদের পাশে ও জয়নুল আবেদিন পার্ক ও সার্কিট হাউসের পাশে এ সংগ্রহশালার অবস্থান। যেন প্রকৃতির মধ্যে শুয়ে আছে শিল্পীর অসাধারণ কিছু চিত্রকর্ম। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি শিল্পী দেশের বিভিন্ন জায়গায় আঁকা তার সব ছবিগুলোকে একত্রিত করে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার চিন্তা করেন; আর শিল্পীর সে সময়কার ভাবনার ফসল বর্তমানের এই সংগ্রহশালাটি। ঘড়ির কাঁটাতে তখন সকাল ৮টা গত রাতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহরে এসেছি। প্রতিদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ছুট দিতে হয় অফিস পানে। আর ডিসেম্বর মাসে আমার ওপর কাজের স্টিম রোলার চলবে। তাই ডিসেম্বর আসার আগেই মনকে সতেজ করার জন্য ভ্রমণের বিকল্প নেই। তাই আমি একদিনের ছুটি নিয়ে ছুটে চললাম। সঙ্গী হিসেবে সব সময়ের মতো মাকে সঙ্গে নিলাম। মা প্রথমে যেতে চাইছিল না। পরে অনেকটা জোর করেই মাকে নিয়ে গেলাম। অনেক দিনের শখ ছিল ময়মনসিংহে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা দেখব। ব্যাটে-বলে মিলে গেল তাই গেলাম ময়মনসিংহে। আমার ছোট ভাই পিকু ময়মনসিংহে থাকে আকুয়া ওয়ারলেসে। পিকুর বাসাতে গিয়ে উঠলাম আমরা। পিকু খুব খুশি ওর বাসায় মাসি এসেছে তাই সকালের খাবার-দাবারের আয়োজনটা বেশ ভালো। লুচি আর আলুর দম সঙ্গে ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী মন্ডা। পেট পূজা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে। বাসা থেকে বের হয়ে আমরা তিন চাকার ব্যাটারিচালিত গাড়িতে উঠলাম। পুরাতন রেলস্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চললাম নির্ধারিত গন্তব্যে। আমরা চলছি রেললাইনের পাস দিয়ে একদিকে ট্রেনের কু ঝিক ঝিক শব্দে এগিয়ে যাওয়া অন্যদিকে শহরের কোলাহল। পিচঢালা রাস্তা পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। দেখতে দেখতে আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউসসংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা এলাকায় বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে পার্ক। আমরা প্রবেশ পথে টিকিট কেটে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললাম। চলতি পথে পিকু বলল, একটি দোতলা দালানকে আশ্রয় করে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলা ১৩৮২ সালের ১ বৈশাখ তারিখে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। সে সময় দেশব্যাপী জয়নুল আবেদিনের বিভিন্ন শিল্পকর্ম সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আর তাই প্রথম দিকেই শিল্পীর নিজের এলাকা তথা ময়মনসিংহে এই সংগ্রহশালাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনের পর ৭ জুলাই সংগ্রহশালার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। আমরা দোতলায় অবস্থিত ছবির গ্যালারিতে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ তাই আর ছবি তুলতে পারলাম না। দোতলায় গিয়ে দেখা মিলল প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল গফুর ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি এসেছেন তার নাতি-নাতনিদের সঙ্গে নিয়ে। গ্যালারিতে চোখে পড়ল শম্ভুগঞ্জ ঘাট, শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ, বাস্তুহারা, প্রতিকৃতি, প্রতিকৃতি, স্কেচ, মহিষের বাচ্চা, কাজী নজরুল ইসলাম, কংকালসার, দুর্ভিক্ষ, রমণী-১, ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, মা ও ছেলে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, কলসী কাঁখে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা ইত্যাদি। আমরা গ্যালারি পরিদর্শন শেষে দেশবরেণ্য অন্য শিল্পীদের চিত্রকর্মের পোস্টার বিক্রি হচ্ছে দেখে সেখান থেকে কয়েকটা পোস্টার কিনলাম। সংগ্রহশালা এলাকার চোখে পড়ল একটি উন্মুক্ত মঞ্চ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে। ব্রহ্মপুত্র শুধু নদ নয়। আর এর জলের ধারাতেই সুন্দরের শেষ নেই। মনে হলো এই নদ ময়মনসিংহ নগরের মানুষের কাছে অনেক কিছুর উৎস এবং নিয়ামক। নির্মল বাতাস আর সবুজের আস্বাদ এখানে অফুরান দিবানিশি যে কারও মনকে ভরিয়ে তুলতে পারে। পাল তোলা নৌকার অবাধ বিচরণ শিল্পীর মানসপটে আঁকা ছবির মতো। ভ্রমণপিপাসু যে কারোর মন ভরিয়ে দিতে পারে এই প্রাকৃতিক পরিবেশ।