হাড়িভাঙ্গায় একদিন

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

সুমন্ত গুপ্ত
খুব ছোটবেলা থেকেই ভ্রমণ কাহিনীর প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। সময় পেলেই ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে পড়তে বসে যেতাম। আর ভাবতাম বড় হয়ে ইবনে বতুতার মতো বের হয়ে যাবো বিশ্ব ভ্রমণে। ভেবে দেখুন বতুতা সাহেব মাত্র ২০ বছর বয়সে পৃথিবী দেখতে বেরিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন তার ৪৯ বছর বয়সে। অথার্ৎ পৃথিবীর পথে পথেই কেটেছে তার ২৯ বছর। সেটা সেই ১৪ শতকের ঘটনা। জলদস্যু, মরুভ‚মির ঝড় আর পাগলা রাজাদের আক্রমণ ঠেকিয়ে বতুতা কখনো হেঁটে, কখনো জাহাজে চড়ে তার বিশ্বভ্রমণ করেছেন। আর এখনকার এই দারুণ প্রযুক্তি ও যোগাযোগব্যবস্থার যুগে আমরা তিন দিন চার রাত ধরে প্যাকেজ ট্যুর ছাড়া কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে জটিল অঙ্ক শেষ করে এক মাস আগে থেকে ঠিক করি কোথায় যাব, কীভাবে যাব, কত দিন থাকব, কোথায় থাকব ইত্যাদি। এরই মধ্যে সবকিছুকে উড়িয়ে দিয়ে ‘বতুতাদশের্’ উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম দেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে ভ্রমণ সঙ্গী আমার মা। কোনো দশর্নীয় জায়গা দেখার ইচ্ছে নিয়ে নয়, ইচ্ছেটা ছিল উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনধারা দেখব। যেখানে রাত হবে, সেখানেই কাত হব; যেতে যেতে যে রাস্তা ভালো লাগবে, সেদিকেই চলতে শুরু করব। এদিকে শুক্র-শনিবারের বন্ধসহ অফিসের ছুটি পেয়েছি একদিন মাত্র তাই তিন দিন সময় এর মধ্যে আমাকে ঘুরে আসতে হবে আগে ভেবেছিলাম ছুটি আরেকটু বেশিদিন পাবো তা পেলে উত্তরাঞ্চলে মোটামুটি ঘুরে আসা যাবে কিন্তু বিধি বাম জুন মাস তাই বড় স্যারের হুকুম একদিনের বেশি ছুটি দেয়া যাবে না তাই আর ভালোভাবে উত্তরাঞ্চল ঘোরার প্ল্যানটা মাঠে মারা যাওয়ার জোগাড়। আমার অফিসের সবাই এক বাক্যে না বলছে এবার না যাওয়ার জন্য খুব গরম পড়েছে আর এত অল্প সময়ে তেমন কিছুই দেখতে পারব না বুঝি এদিকে আমি নাছোড়বান্দা যেহেতু যাব বলেছি সেহেতু যাবই। সব প্রতিক‚লতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে আমি আর আমার মা রওনা দিলাম উত্তরাঞ্চলের দিকে। আমার আবার ট্রেনে করে ভ্রমণ করতে খুব ভালো লাগে। সে মোতাবেক আমরা রওনা দিলাম ঢাকা থেকে সকালের ট্রেনে উত্তরাঞ্চলে দিকে। সকাল ৯টায় আমাদের ট্রেন রংপুর এক্সপ্রেস। ৯টার আগেই আমরা স্টেশনে এসে উপস্থিত কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে কিছুটা বিলম্বে যাত্রা যেন প্রথাগত ব্যাপার। ৯টার ট্রেন ১০টায় ছাড়লো আমরা যাত্রা শুরু করলাম। প্রকৃতির মায়াবী রূপকে সঙ্গী করে ট্রেন তার সেই মধুর কু ঝিক ঝিক ঝিক শব্দে এগিয়ে চলল। ট্রেনের ঝক ঝক শব্দ, যানজটবিহীন পথ যে কারোরই ভালো লাগার কথা। ট্রেন লাইনের দুই পাশে কখন বস্তি আবার কখন সারি সারি গাছের মধ্যে ছুটে চলছে। আশপাশে বাড়ি-ঘর সবকিছুকে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে ট্রেন তার গন্তব্যে। ট্রেনের জানালার পাশে বসে প্রকৃতির রূপ দেখা খুবই উপভোগ্য। মাঝেমধ্যে ট্রেনের গতি কমে এলেই মানুষের তার গন্তব্যে নেমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। বঙ্গবন্ধু সেতুপূবর্, চাটমোহর, নাটোর, সান্তাহার, বগুড়া পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যে। ট্রেনে বসে কথা হলো প্রকৃতি বাংলাদেশের সুজন সেনগুপ্তের সঙ্গেÑ তিনি বললেন, সময় যেহেতু কম তাই কম সময়ে রংপুর বিখ্যাত হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান দেখে আসার পরামশর্ দিলেন সঙ্গে দিলেন আবু জাহিদ ভাইয়ের মোবাইল নম্বর। আবু জাহিদ ভাইয়ের বাড়ি রংপুরে তার রংপুরের পদাগঞ্জ এলাকায় তিন একর জায়গার ওপর আম বাগান আছে। রাত ৮টা আমাদের ট্রেন এসে নোঙর করল রংপুর স্টেশনে আগে থেকে আবু জাহিদ ভাই স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। রংপুর স্টেশন থেকে আমরা রিকশা করে জাহাজ কোম্পানি মোড়ে গোল্ডেন টাওয়ার হোটেলে পেঁৗছালাম বেশ শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। কিছু সময় রেস্ট নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাতের অঁাধারে রংপুর শহর ঘুরতে। রংপুর শহরের জুম্মাপাড়া, গোমস্ত পাড়া, বেদ পট্টি, স্টেশন রোড, নবাববাড়ি, আমলাতলা এলাকাগুলো আমরা রিকশা করে ঘুরে বেড়ালাম। পায়রা চত্বরে এসে দেখা মিলল মিষ্টি দোকান পুষ্টির আমি আবার মিষ্টি দেখলে লোভ সামলাতে পারি না অগত্যা মা না বলার পরে ও মিষ্টি দোকানে ঢুকে হরেক রকম মিষ্টি চোখে দেখলাম অসাধারণ টেস্ট ঢাকা শহরের তুলনায় মিষ্টির দাম তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম তাই তিন বক্স শুকনো মিষ্টি সঙ্গে করে নিলাম ঢাকাবাসীর জন্য। পরের দিন সকালবেলা আবু জাহিদভাই এসে উপস্থিত আমরা নাশতা করে বের হয়ে পড়লাম গন্তব্য মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ গ্রামে আমের বাগান। আমরা সিএনজি করে যাত্রা শুরু করলাম পথিমধ্যে আবু জাহিদ জানালেন, আমের নাম কেন হাড়িভাঙ্গা হলো এ নিয়ে লোকজনের মধ্যে নানা কথার প্রচলন রয়েছে। তবে যতদূর জানা যায়, পদাগঞ্জের এক ব্যক্তি বাজার থেকে আম কিনে আনেন। সেই আম খেয়ে তিনি বীজটি রেখে দেন একটি পরিত্যক্ত হাড়িতে। ওই হাড়িতেই বীজ থেকে চারা গাছ বের হয়ে আসে। আর সেই গাছটি তিনি বাড়ির পাশে রোপণ করেন। ওই ব্যক্তির নিবিড় পরিচযার্য় গাছে আম ধরতে শুরু করে। হাড়ি থেকে ওই আমের উৎপত্তি হওয়ায় এর নাম হয় হাড়িভাঙ্গা আম। এদিকে মা শুরু করলেন তার স্মৃতির কুঠোর থেকে আমের ইতিহাস বলাÑ খ্রিস্টপূবর্ ৩২৬ অব্দে দিগি¦জয়ী বীর সম্রাট আলেকজান্ডার ভারতবষর্ আক্রমণের পর এক আম বাগানে তঁাবু গেড়ে বিশ্রাম নেয়ার সময় আমের সঙ্গে পরিচিত হন। সুস্বাদু আম খেয়ে এতটাই ভক্ত হয়ে পড়েন যে প্রাসাদের চার ধারে আমের বাগানে ছেয়ে দেন। প্রাচীন শাস্ত্রে আমগাছকে ‘কল্প বৃক্ষ’ হিসেবে বণর্না করা হয়েছে। কখনো বলা হয় ইচ্ছাপূরণের বৃক্ষ। আমের পাতা মঞ্জরিকে নিয়ে আছে লোককাহিনী। আমের কচিপাতার ডাল শুভ ও মঙ্গলকাজে ব্যবহার হয়। পনেরো শতকের দিকে স্পেনিশ পরিব্রাজক ও পতুির্গজরা মহাদেশে আম নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় প্রাচীন চীনা পযর্টক হিউয়েন সাং ও আরব অভিযাত্রী ইবনে হানকাল আমের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে ভ্রমণ কাহিনীকে সমৃদ্ধ করেন। তারও বহু আগে প্রেমের দেবতা কিউপিড মানব হৃদয়ে প্রণয় জাগাতে প্রেমের তীরের অগ্রভাবে আমের মুকুল গেঁথে দেন। আম মুঘল সম্রাট আকবরের এতটাই প্রিয় ছিল যে, আম দিয়েই শুরু হতো অতিথি আপ্যায়ন। দেখতে দেখতে আমরা এসে পেঁৗছালাম আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্য পদাগঞ্জে। এখানে এসেই চোখে পড়ল বিস্তীণর্ এলাকা জুড়ে শুধু হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান। যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে শুধু বাগান আর বাগান। এমন কেউ নেই যিনি বাড়ির আঙিনা, উঠান কিংবা ফসলি জমিতে আমের গাছ রোপণ করেননি। আবু জাহিদ ভাই তার বাগানে নিয়ে গেলেন। বিশাল এলাকা নিয়ে জাহিদভাইয়ের আম বাগান কতটুকু এলাকা নিয়ে জানতে চাইলে জাহিদভাই জানালেন চার একর জায়গার ওপর তার বাগান। ছয় বছর ধরে তিনি আমের বাগান করছেন। আর আপনারা যে গাছগুলো দেখছেন তাদের বয়স চার বছর। প্রতি গাছ থেকে তিন থেকে চার মণ আম পাওয়া যায়। আম পাকলে কিছুটা লালচে রং ধারণ করে। প্রতিটি আমের ওজন ২০০ গ্রাম থেকে ৪০০ গ্রাম পযর্ন্ত হয়ে থাকে। এত আম দেখে লোভ কি সামলানো যায় আপনারাই বলুন, তাই নিলের্জ্জর মতো জাহিদভাইকে বললাম আম খাওয়াবেন না জাহিদভাই জিভে কামড় দিয়ে বলে আরে ভুলেই গিয়েছিলাম আপনাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ল দুলালভাইয়ের তিনি এখানে দেখভাল করেন। শুরু হলো আমাদের আম খাওয়ার পবর্। একের পর এক আম সাবাড় করছি হঠাৎ মনে হলো অনেক সময় শুনি আম বাগানে আম পাকানোর জন্য কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় বুঝি। তাই জাহিদভাইকে জিজ্ঞেস করলাম আপনারা কীটনাশক দেন নাই তো আম পাকানোর জন্য? জাহিদভাই বললেন, আপনারা নিশ্চিন্তে খেতে পারেন আম। আমার এখানে শুধু আমের মুকুল আসার আগে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় শুধু পোকামাকড় আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। দেখতে দেখতে আমাদের শহর পানে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এলো। ফিরে যাওয়ার আগে আবু জাহিদভাই মিল বাজার এলাকার বিখ্যাত লুচি আর সবজি খাইয়ে আমাদের বিদায় দিলেন। পথের ঠিকানাÑ ঢাকা থেকে ট্রেন করে রংপুর ভাড়া নেবে ৩৯০ থেকে ১৩৯৫ টাকা অথবা বাসে করে (এসআর ট্রাভেলস, এসএ পরিবহন, নাবিল এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন প্রতিটির এসি/ নন এসি বাস আছে) রংপুর ভাড়া ৪৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। রংপুর শহর থেকে অটো করে পদাগুঞ্জ রিজাভর্ নিলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বাস করে গেলে ৩০ টাকা।