রক্তরাঙা শিমুল বাগান

প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২০, ০০:০০

মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম
এলোরে বসন্ত। গাছে গাছে কোকিলের মিষ্টি সুরেলা গান। ছায়াঘেরা নিরিবিলি পরিবেশে, অনবরত কুহুকুহু ডাক। আর সেই সুরেলা আওয়াজ যদি হয় রক্তরাঙা শিমুল ফুল ফোটা গাছের তলায় তা হলে তো আর কথাই নেই। পুরো বাগানজুড়ে এখন ফুটন্ত শিমুল ফুল। কাক ডাকা ভোরে গাছে থাকা থোকায় থোকায়, আর ঝরে পড়া সবুজ ঘাসের ওপর বিছানো ফুলগুলো দেখার মধ্যে এক অন্যরকম অপার্থিব সুখ অনুভূত হয়। সুনামগঞ্জ জেলার রক্তরাঙা শিমুল বাগান দেখার জন্য ভ্রমণ যখন পিপাসুরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে তখন আমাদের দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরাও বাদ যায়নি। অনেকে শুধু বাগান ঘুরেই আবার ফিরতি পথ ধরেছিলেন। কিন্তু সেই জেলাতেই যে আরও কত রকমের মায়াবী প্রকৃতির ছড়াছড়ি রয়েছে তা হয়তো জানা ছিল না অনেকের। প্রায় ১০০ কেয়ার [ত্রিশ শতাংশে এক কেয়ার] জমির ওপর সৃজন করা শিমুল বাগানে তাঁবু টানিয়ে রাত্রি যাপন আর ঝলসানো আগুনে দেশি মোরগের গোস্ত পুড়ে খাওয়ার মজাই ছিল অন্যরকম আনন্দের। সেই সঙ্গে হুট করেই আয়োজন করা, বাগানের ভিতরেই ভাতের পাতে হাওরের রুই আর গুঁড়া চিংড়ি। ওহ্‌ আর বলা যাবে না, এখনো জিভে জল চলে আসে। আমাদের এহেন কান্ডে এতক্ষণ আশপাশ থেকে যারা এসে জড়ো হয়েছিল, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যে যার মতো চলে গেল। একসময় পুরো বাগানজুড়ে শুধু আমরাই ৬ জন। রাত্রি যখন গভীর সুনসান নিরিবিলি, পুরো শিমুল বাগানজুড়ে নৈঃশব্দ। সঙ্গী তখন চৌধুরীর অনবরত কর্কশ নাক ডাকার আওয়াজ আর মাঝেমধ্যে দু-চারটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ। তাতে মন্দ লাগেনি। বাগানের পাশেই নদীর পানি বয়ে চলেছে অজানায়। মায়াবিনী জাদুকাটা নদীর ওপার ভারতের মেঘালয় প্রদেশের সীমান্ত চৌকির উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাতিগুলো জ্বল জ্বল করছিল। ভর বসন্তেও ছিল শীতের হিমহিম হাওয়া। প্রকৃতির নিস্তব্ধতাও ভিন্নরকম ভালোলাগার। যা আপনার ভাবুক মনকেও নদীর পানির মতো নিয়ে যাবে দূর অজানায়। ভাবুক মনের ক্লান্তি দেহে ভর করলে- এক সময় ঘুমের দেশে হারিয়ে যাই। উঠি খুব সকালে। সূর্যাস্তের বিকাল আর সূর্যোদয়ের সকালে এরকম দুটো সময়েই আমরা শিমুল বাগানের রূপ-রঙের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে বেশ আপস্নুত হই। বাগানের পাশের এক বাড়িতে দ্রম্নত সাফসুতর হয়ে, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলা স্টাফ রিপোর্টার হাবিব সরোয়ার আজাদ ভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে বাইকে করে ছুটি নেত্রকোণার কমলাকান্দার পথে। কিছুটা পথ এগিয়েই থামি গিয়ে লাউড়ের গড় বারেকটিলা। একটি পিলার দিয়েই ভারত-বাংলাদেশের সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশেই জাদুকাটা নদীর দৃষ্টিনন্দন তীর। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ধু-ধু মরু প্রান্তর। অসাধারণ এক নজরকাড়া প্রকৃতি। চা-চক্র শেষে আবারও ছুটি। ভারত সীমান্তের উঁচু উঁচু পাহাড়ের পাদদেশ বাংলাদেশ সীমান্তের সড়ক পথে মোটরসাইকেল চলে দুর্বার গতিতে। বাইক এসে থামে টেকের ঘাট শহিদ সিরাজ লেক। টলটলে নীলাভ পানির লেক। চার পাশে উঁচু নিচু পাহাড় আর টিলার মধ্যে লেকটির অবস্থান। অতি উৎসাহীরা নীলাদ্রি নামে ডেকে থাকে। কেউবা বাংলার কাশ্মীর হিসেবেও সম্বোধন করে থাকে। তবে যে যে নামেই ডাকুক না কেন শহিদ সিরাজ লেকটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য। এরপর ছুটে চলি টাঙ্গুয়া হাওরের পানে। মোটরবাইক চলে সরু পথ ধরে। মাঝে লাকমাছড়া খানিকটা বিরতি। সাদা পাহাড়ের পাশে বেশ ভালোই লাগে। এবার যাচ্ছি বাগলী বাজার। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাই। স্থানীয় এক দোকানে চলে যার যা ইচ্ছেমতো পুরি, সিঙ্গাড়া, ছোলা, পিঁয়াজি, মুরলি, মিষ্টি আর গরুর দুধের মাস্তি। ইতিমধ্যে আজাদ ভাইয়ের পরিচিত শেখ মোস্তফা ভাইও লোকজন পাঠিয়ে দিয়েছেন। দে-ছুট বন্ধুদের নিয়ে যাবে ইন্দ্রপুর গ্রামে। সেখানে রয়েছে টাঙ্গুয়ার হাওর। সবাই রেডি-বাইক স্টার্ট। ছুটছি তো ছুটছি, একসময় ইন্দ্রপুর গ্রামের মায়াময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে হাওরের বুক চিরে আমরা এগিয়ে যাই। বর্ষায় যখন হিজল কড়চ গাছগুলো প্রায় ডুবু ডুবু তখন এই মৌসুমে আমরা সেখান দিয়ে হেঁটে বেড়াই। জলের ধারে পৌঁছে নাও পাই কিন্তু মাঝি নাই। অগত্যা নিজেরাই নাও বেয়ে হাওরের স্বচ্ছ জলরাশিতে ভেসে বেড়াই। হাওরের এপাশটা মাছের অভয়াশ্রম। তাই পাখির দেখাও মেলে বেশ। বেলা প্রায় ৩টা। পেটেও টান পড়েছে। যাই এবার মহিষখোলা। যাওয়ার পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কীভাবে এই স্বল্প লিখনীতে প্রকাশ করব তা ভেবে পাচ্ছি না।