বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তনে জীববৈচিত্র্য ও অভিযোজনের প্রভাব

এম এ আলম
  ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী কৃষি ও মৎস্যজীবী। আজ ষড়ঋতুর অস্তিত্ব অনুভব ভাগ্যের ব্যাপার। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি শিকার উপকূলবাসী এবং কৃষিজীবীরা। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ ভূমি খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং কৃষি প্রতিবেশ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি অংশে দেখা যায়। কৃষি প্রতিবেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী, বিস্তৃৃত ও বৈচিত্র্যময়। দ্রম্নত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কৃষিতে সনাতনী পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতি চালু হয়েছে। ১২,০০০ বছর আগে যখন থেকে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে তখন থেকে খাদ্যের জন্য প্রায় ৭০০০ উদ্ভিদ প্রজাতি চাষ করা হচ্ছে। এমনকি আজকের মাত্র ১৫টির মতো উদ্ভিদ ও ৮টি প্রাণী প্রজাতি আমাদের খাদ্যের ৯০ শতাংশ সরবরাহ করে। এসব আধুনিক শস্যতে বিভিন্ন গুণাগুণ সংযোজন করা হয়েছে বন্যপ্রজাতি থেকে। এর ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সব ধরনের জীবন ও জীবিকা জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটছে যা মৎস্য প্রজাতির হ্রাস ও বিলুপ্তি ঘটাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অতিথি পাখিদের আগমনের সময় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তিত হওয়ার ফলে অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে রয়েছে সিডর, নার্গিস, বিজলি ও আইলায় বিধ্বস্ত উপকূলের পরিবেশ। পরিবেশের এ বিরূপ আচরণের জন্য শঙ্কিত দেশবাসী। বন্যা, খরা অতি বৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানির ঘটনা ঘটে। ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে সামগ্রিক খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মধ্যে রয়েছে। অথচ প্রাচীনকাল থেকে আমাদের এদেশ জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ। এখানে ২৬৬ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ মৎস্য, ৪৪২ প্রজাতির সামুদ্রিক মৎস্য, ২২ প্রজাতির উভচর, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির স্থানীয় পাখি, ২৪০ প্রজাতির অতিথি পাখি, ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ৫০০০-এর অধিক উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। এদেশে বিভিন্ন ধরনের বনভূমি রয়েছে। পত্রঝরা বনাঞ্চল, চিরহরিৎ বনাঞ্চল ও প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল এদেশে অবস্থিত। আমাদের এদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এদেশে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড় ইত্যাদি বিভিন্ন জলবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ।

জলবায়ু পরিবর্তন প্রজাতির স্বাভাবিক অভিপ্রয়াণ ও বিস্তৃৃতিকে অনেক মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। অনেক প্রজাতির ক্ষেত্রেই যা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকে না এবং প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। রোগ-বালাই, আগুন, অনুপ্রবেশকারী প্রজাতি ইত্যাদির মাত্রাও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়তে পারে। স্থলজ উদ্ভিদকুলের কার্বনের ৮০ ভাগ সঞ্চিত আছে বনে। বন ধ্বংস, বনভূমি পরিষ্কার করা ইত্যাদির ফলে প্রতি বছর ১.৭ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে অত্যধিক কুয়াশার কারণে আম ও অন্যান্য ফসলের মুকুল নষ্ট হচ্ছে এবং সামগ্রিক উৎপাদন কমে যাচ্ছে। পরিবর্তিত আবহাওয়া পরিস্থিতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার পর গ্রামাঞ্চলের অনেক গর্তবাসী জীববৈচিত্র্যের সংখ্যা কমে গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণের দ্বীপগুলো ও সুন্দরবনের ২০ শতাংশ পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক প্রাণী ও উদ্ভিত প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।

খাদ্যশস্যের বন্যপ্রজাতিগুলোকে ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিপূরণের কৌশল হিসেবে বিবেচনা করা হয় কারণ নতুন প্রজাতি উৎপাদনে কেবল এগুলো ব্যবহৃত হতে পারে যা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত খাদ্যশস্যের অনেক বন্য জাত হুমকির মুখে। ধারণা করা হয় যে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সব আলুর প্রজাতির এক-চতুর্থাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে যা ভবিষ্যতে নতুন জাত উদ্ভাবনে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এসব খাদ্যশস্যের বাণিজ্যিক জাত পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারে না।

পৃথিবীর মোট স্থলভাগের এক-তৃতীয়াংশই বনভূমি। স্থলজ জীববৈচিত্র্যের দুই-তৃতীয়াংশই বনভূমিতে বাস করে। ৮০০০ বছরে পৃথিবীর প্রায় ৪৫ ভাগ বনভূমি ধ্বংস বা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। বন প্রচুর সম্পদ ও সেবা প্রদান করে থাকে। বনে বসবাসকারী অধিকাংশ বড় প্রাণী, নরবানরের অর্ধেক অংশ, প্রাণী ও জানা উদ্ভিদ প্রজাতির ৯ ভাগ বিলুপ্তির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বড় উদ্ভিদ অভিযোজন বা বিস্তৃৃত হওয়ার কোনো সামর্থ্য নেই।

ভবিষ্যতে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য শস্য ও পশুসম্পদের ইন সিটু এবং একস সিটু সংরক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি জীববৈচিত্র্যের ইন সিটু সংরক্ষণ করতে বোঝায় কৃষক দ্বারা বিভিন্ন শস্যের উৎপত্তিস্থলে তাদের ব্যবস্থাপনা। এটা শস্যের নিজস্ব পরিবেশে তাদের বিবর্তন ও অভিযোজনকে সমর্থন করে। একস-সিটু সংরক্ষণ বলতে প্রজাতি সমূহের তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে সংরক্ষণ করাকে বোঝায়। যেমন- শস্য ব্যাংক ও চিড়িয়াখানা। কৃষি প্রতিবেশের বিভিন্ন উপাদান পণ্য এবং সেবা দিয়ে থাকে। যেমন- প্রাকৃতিক পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ, পরাগায়ন এবং বীজের বিস্তার। পৃথিবীর শস্য উৎপাদনের ৩৫ ভাগ পরাগায়নের জন্য মৌমাছি, পাখি, বাদুড় ইত্যাদি বিভিন্ন প্রাণীর উপর নির্ভরশীল।

পরিবর্তিত আবহাওয়া পরিস্থিতিতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অভিযোজনে সহায়তা করতে পারে। জীববৈচিত্র্যের আবাসভূমি নিরবচ্ছিন্ন রাখা। স্থানীয় জাতগুলো চাষাবাদে উৎসাহিত করা যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। লবণাক্ত এলাকায় সহনীয় ধান বা শস্যের উদ্ভাবন ও আবাদের প্রসার ঘটানো। যেসব ফসল স্বল্প সময়ে বন্যার আগে তুলে ফেলা সম্ভব সেগুলো বেশি করে চাষাবাদ করা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে কচুরিপানার ভাসমান ধাপে সবজি ও বীজতলায় চাষাবাদ বাড়াতে হবে যার ফলে আগাম বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। স্থানীয় প্রজাতির বনায়ন, কৃষি জমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবহারে দক্ষতা বাড়ানো ও পতিত কৃষি জমির পুনঃসংস্কার করতে হবে। মিথেন গ্যাসের নির্গমন কমানোর জন্য ধান চাষপদ্ধতির উন্নতি করতে হবে। কার্বন শোষণের ব্যাপারেও কৃষি জমির একটি ভূমিকা রয়েছে। উন্নত ব্যবস্থাপনা কৃষি জমিতে কার্বন শোষণের মাত্রা বাড়াতে পারে। এজন্য শস্যের বর্জ্য ব্যবহার করা উচিত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষককে আগাম দুর্যোগ তথ্য ও দুর্যোগ হ্রাসের পদ্ধতি জানাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও পরিবেশের বাস্তুসংস্থান ঠিক রাখার জন্য জৈব কৃষির প্রসার ঘটাতে হবে। জৈব কৃষির আদর্শ হিসেবে কিউবা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোর কৃষিব্যবস্থাকে অনুসরণ করা যেতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে