কম্পিউটার প্রযুক্তি বিজ্ঞানের এক অনন্য উদ্ভাবন

প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

শেখ একেএম জাকারিয়া
আধুনিক বিজ্ঞানের উদ্ভাবনগুলোর মধ্যে অনন্য উদ্ভাবন কম্পিউটার। কম্পিউটার উদ্ভাবন মানব সভ্যতায় এক আগাগোড়া রূপান্তর এনে দিয়েছে। এ যেন রহস্যে আবৃত মেশিন মানব। যা মানবজাতির দুর্বোধ্য বিষয়গুলো মুহূর্তের মধ্যে সমাধান করে দিতে পারে। তবে অবিনশ্বর সত্য এই যে, সব ভালো জিনিসেরই কিছু না কিছু মন্দ দিক থাকে। কম্পিউটারও এর অন্যথা নয়। কম্পিউটারের ভালো-মন্দ সব ইতিহাস তুলে ধরাই আজকের প্রযুক্তি বিজ্ঞানের অনন্য উদ্ভাবন কম্পিউটার রচনার প্রধান বিষয়। অনেকেই জানি, শিল্পবিপস্নবের পর থেকে মেশিন বিজ্ঞানের জয়লাভের উদ্দেশ্যে যাত্রা অপ্রতিহত রয়েছে। বিস্ময় উদ্রেক করে এমন সব উদ্ভাবনের মধ্যদিয়ে মানবজাতি দুর্নিবার সামর্থের অধিকারী হয়েছে মেশিনশক্তিতে। হালের অধুনাতন বিজ্ঞানের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আশ্চর্য ও অতি আধুনিক উদ্ভাবন হলো কম্পিউটার। কম্পিউটারের নির্দিষ্ট কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। পৃথিবীজুড়ে কম্পিউটার নামেই এর পরিচয়। বাংলা অভিধানে কম্পিউটারের অর্থ করা হয়েছে এভাবে: উপাত্ত সংরক্ষণ বিশ্লেষণ ও পূর্ব নির্দেশানুযায়ী পর্যায়ক্রমে দ্রম্নত কার্যসম্পাদনে সক্ষম বিদু্যতিনীয় সরঞ্জাম বিশেষ। এছাড়া কম্পিউটারের আরেকটি প্রতিশব্দ 'পরিগণক' দেখানো হয়েছে। সহজ অর্থে কম্পিউটার কী, আমরা তা প্রায় সবাই জানি। কম্পিউটার হলো অনেকগুলো বৈদু্যতিক মেশিনের সমাহার। যা বৈদু্যতিক প্রবাহের মাধ্যমে যুক্তিসিদ্ধ কাজ সম্পাদন করে থাকে। কম্পিউটার বৈদু্যতিক তরঙ্গকে নিজের সংকেতে রূপান্তর করে ব্যবহারকারী কর্তৃক কমান্ডের দ্বারা উদ্ভূত সমস্যার সমাধান করে থাকে। কম্পিউটার এসেছে ল্যাটিন শব্দ কম্পিউট থেকে। কম্পিউট শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো গণনা করা। তাই আভিধানিকভাবে কম্পিউটার হলো একটি গণনা করার মেশিন বা যন্ত্র। কিন্তু বর্তমানে এ কম্পিউটার শুধু গণনা করার কাজের মধ্যে সীমিত নেই, বরঞ্চ এ যন্ত্রটি আজ আরও নানা কাজে বহুলাংশে ব্যবহৃত হচ্ছে। কম্পিউটার তৈরির ইতিহাস খুবই চমকপ্রদ। কে তৈরি করল কম্পিউটার নামক জাদুর ডিভাইসটি? এ প্রশ্নের জবাবে সর্বপ্রথম যার নাম আসে তিনি হলেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ গণিত শাস্ত্রবেত্তা চালর্স ব্যাবেজ। যাকে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, কম্পিউটার তৈরির ইতিহাস আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরানো! প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে গ্রিক সভ্যতায় 'অ্যাবাক্যাস' নামে এক ধরনের গণনা যন্ত্র উদ্ভাবিত হয়েছিল। পরবর্তীতে চীনসহ বিশ্বের অনেক দেশেই 'অ্যাবাক্যাস' ব্যবহৃত হতো। ১৬৪২ সালে ১৯ বছর বয়সি ফরাসি বিজ্ঞানী বেস্নইজ প্যাসকেল প্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর বা যন্ত্রগণক উদ্ভাবন করেন। এরপর চার্লস ব্যাবেজ রিসার্চ করেছিলেন এই যন্ত্রগণককে আরও দুর্বোধ্য কোনও কাজে লাগানো যায় কী-না। অথচ দুঃখের কথা, দরকারি যন্ত্রপাতি ও টাকার অভাবে তিনি কাজটি সফল করতে পারেননি। বাস্তবিকপক্ষে কম্পিউটার বিজ্ঞানের সূত্রপাত হয় আল্যান টুরিংয়ের প্রারম্ভে তাত্ত্বিক ও পরে ব্যবহারিক তত্ত্বানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে। শেষে ১৮৩৩ সালে মর্ডান কম্পিউটারের সূচনা হয়। গঠন ও চলননীতির ওপর ভিত্তি করে কম্পিউটারকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন- অ্যানালগ কম্পিউটার, ডিজিটাল কম্পিউটার ও হাইব্রিড কম্পিউটার। এছাড়া আকৃতি, মূল্য ও প্রয়োগের তাৎপর্যের ওপর নির্ভর করে ডিজিটাল কম্পিউটারকে পুনরায় চার ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন সুপার কম্পিউটার, মিনি কম্পিউটার, মেইনফ্রেম কম্পিউটার ও মাইক্রো কম্পিউটার। মাইক্রো কম্পিউটার আবার দুই ধরনের হয়ে থাকে। যেমম- ডেস্কটপ ও ল্যাপটপ। এবার কম্পিউটার মগজ নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যাক। হালের অধুনাতন কম্পিউটার একেবারে মানব মস্তিষ্কের মতো। যাকে আধুনিক যুগের মানুষ যন্ত্র মস্তিষ্ক বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক কম্পিউটার মুহূর্তেই আমাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে তার মাথায় ধরে রাখা স্মৃতি অর্থাৎ তথ্যের প্রয়োগ ঘটিয়ে। কম্পিউটার মগজ সাধারণত তিনটি বিশেষ অংশ নিয়ে গঠিত। যেমন- সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ), ইনপুট ও আউটপুট। উলিস্নখিত বিশেষ অংশগুলোর মধ্যে সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ) হচ্ছে কম্পিউটারের মগজ। কেননা, কম্পিউটারের এ অংশ যে কোনো সমস্যাসংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে। আর ইনপুটের কাজ হচ্ছে তথ্যানুযায়ী নির্দেশ গ্রহণ করা। যেমন কি-বোর্ড, মাউস, ডিস্ক, স্ক্যানার, কার্ড রিডার, ডিজিটাল ক্যামেরা ইত্যাদি কম্পিউটারের ইনপুট যন্ত্রপাতি। অন্যদিকে আউটপুট হচ্ছে- ইনপুটে পাওয়া নির্দেশকে ফলাফল হিসেবে প্রকাশ করা। যেমন- মনিটর, প্রিন্টার, ডিস্ক, স্পিকার, প্রোজেক্টর, হেড ফোন ইত্যাদি কম্পিউটারের আউটপুট যন্ত্রপাতি। কম্পিউটারে নির্দেশ ও তথ্য প্রদানের জন্য যে নির্ধারিত ভাষার ব্যবহার হয়ে থাকে, তাকে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বলে। আর যেসব তথ্য নিয়ে কম্পিউটার কাজ করে তাকে ডেটা বা উপাত্ত বলে। আধুনিক কম্পিউটারের নেতিবাচক দিক হচ্ছে, একসঙ্গে অনেক তথ্য ও প্রোগ্রামের অদল-বদলের মাধ্যমে, কম্পিউটারের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সাইবার অপরাধ, হ্যাকিং প্রভৃতি বেড়ে যাচ্ছে। যে কারণে অনেক মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু অসিদ্ধ মানুষ। এছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারের সম্মুখে বসে থাকার কারণে মানুষের কোমরে-পিঠে-ঘাড়ে ব্যথা, চোখের বিভিন্ন সমস্যাসহ আরও বিবিধ (শারীরিক ও মানসিক) সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য কম্পিউটার যেমন তাদের শিক্ষাগ্রহণের পথকে সহজ করে দিয়েছে তেমনি কম্পিউটারের নেশা শিক্ষার্থীদের তাদের লেখাপড়া থেকে দূরেও ঠেলে দিচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় তারা মানসিক ও শারীরিক সমস্যাতেও ভুগছে। শুধু শারীরিক ও মানসিক সমস্যাই নয়, কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসি, চাঁদাবাজি, বস্ন্যাকমেলসহ নানা ধরনের ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ছে। আর এ কারণেই মানবজীবনে কম্পিউটার আশীর্বাদ না অভিশাপ এ নিয়ে যে সংশয়, তা হয়তো কোনোদিনও দূর হবে না। এক সরকারি সমীক্ষণে দেখা গেছে, কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে সরকারি ক্ষেত্রে চাকরি সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে যা প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে অন্য ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ বেড়েছে। এ সময়ে কম্পিউটারের মতো এক বিশেষ প্রযুক্তিবিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্যতা চিন্তাই করা যায় না। তাই ভুল ব্যবহারের কারণে কম্পিউটার মাঝেমধ্যে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ালেও সবমিলিয়ে মানবজীবনে কম্পিউটার এক মঙ্গলসূচক পরিবর্তন এনেছে তা মানতেই হবে।