শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিজ্ঞানের উন্নতি প্রযুক্তির চলমান চিত্র

মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাচেতনা, স্বপ্ন আর বাস্তবতার পরিবর্তন এনেছে। বিজ্ঞানের জাদুর কাঠিতেই যেন প্রকৃতির ভেদ-ভেদাঙ্ক সবই উন্মোচিত হয়েছে। বিজ্ঞানের জন্মই হয়েছে অজানাকে জানা আর অধরাকে ধরার অভিপ্রায়ে। বিজ্ঞানের মূল টার্গেটই হলো অনুসন্ধিৎসা। প্রকৃতির নানা রূপের বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য জানাই বিজ্ঞানের আসল কাজ। আর এ কাজের মধ্যে কার্যকারণাত্মক সম্পর্ক বা যোগ আছে কিনা তাও বিজ্ঞান ছেঁকে ছেঁকে বের করে। তাই বলি, বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতি ও বিশ্বব্রহ্মান্ড সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান অর্জন করা
গোলাম মোর্তুজা
  ১৬ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

বিজ্ঞান অর্থ বিশেষ জ্ঞান। বিজ্ঞানের এ যাত্রা কবে শুরু হয়েছে দিন, ক্ষণ, সময় বলা না গেলেও এ কথা তো বলাই যায়, মানুষের প্রয়োজনেই বিজ্ঞানের উদ্ভব হয়েছে। একসময় প্রকৃতির অপার রহস্য মানুষকে ভাবিয়েই তোলেনি, ভয়ও দেখিয়েছে। সেই আদিম যুগ থেকে আজকের যে বিজ্ঞানের যুগ তাও কিন্তু একদিনে আসেনি। প্রকৃতির হাতে মানুষ এক সময় ক্রীড়ানক ছিল। প্রকৃতির রহস্যঘেরা সময়গুলোতে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হলেও পরক্ষণেই ভেবেছে তা কীভাবে জয় করা যায়। প্রকৃতির ওপর নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা থেকে মানুষ কখনই পিছপা হয়নি। একবার নিজেকে গুটিয়ে নিলেও পরক্ষণেই আবার নিজেকে মেলে ধরার প্রচেষ্টা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চলছে আর চলবেও তা নিরন্তর কাল ধরে। ভাবনার করিডোরে সারাক্ষণ মানুষ ভেবেই হয়েছে সারা। অতলান্ত রহস্য মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রকৃতির এ রহস্যাবরণ উন্মোচন করতেই মানুষের সাধনা অব্যাহত ছিল। একদিন মানুষ আর ভয় না পেয়ে ভয়কে জয় করার মানসে কাজ শুরু করে। একে একে রহস্যভেদ করে প্রকৃতির শক্তি, সম্পদ ও ভয়ার্ত পরিবেশকে জয় করে নিজেদের বিজয় কেতন উড়িয়েছে।

মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাচেতনা, স্বপ্ন আর বাস্তবতার পরিবর্তন এনেছে। বিজ্ঞানের জাদুর কাঠিতেই যেন প্রকৃতির ভেদ-ভেদাঙ্ক সবই উন্মোচিত হয়েছে। বিজ্ঞানের জন্মই হয়েছে অজানাকে জানা আর অধরাকে ধরার অভিপ্রায়ে। বিজ্ঞানের মূল টার্গেটই হলো অনুসন্ধিৎসা। প্রকৃতির নানা রূপের বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য জানাই বিজ্ঞানের আসল কাজ। আর এ কাজের মধ্যে কার্যকারণাত্মক সম্পর্ক বা যোগ আছে কিনা তাও বিজ্ঞান ছেঁকে ছেঁকে বের করে। তাই বলি, বিজ্ঞান হচ্ছে প্রকৃতি ও বিশ্বব্রহ্মান্ড সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান অর্জন করা। বিজ্ঞানের কাজ কোনো কিছু সৃষ্টি করা নয়। ঘটনার পারিপার্শ্বিক আবিষ্কার আর তা যুক্তির নিক্তিতে বিচার করাও বিজ্ঞানের বিবেচ্য বিষয়। সমস্যা দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে সমস্যার সমাধান দেওয়ার কাজ কিন্তু বিজ্ঞানের নয়। আর এটাও সত্য কথা, সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া থেকে বিজ্ঞানের উৎপত্তি লাভ করেনি।

মানুষ থেমে থাকতে জানে না। চলতে গিয়েই মানুষ নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছে। সেই বাধাকে অতিক্রম আবার মানুষই করেছে। যে অবস্থাতেই মানুষ থাকুক না কেন, মানুষ কিন্তু পরিতৃপ্ত হন না। তবে পশুপাখির ক্ষেত্রে কিন্তু আলাদা। যেমন ধরুন, বাঘ, সিংহ, ভলস্নুক বা তারচেয়েও ভয়ঙ্কর প্রাণীরা কিন্তু অট্টালিকাতে থাকতে চায় না। ওদের খাবার আর একটু থাকার জায়গা হলেই চলে। আবার যদি পাখির কথা বলি। ওদের শুধু একটা খোলা সবুজ আকাশ আর থাকার মতো একটু জায়গা হলেই ব্যস আর কোনো কথাই নাই। কিন্তু মানুষের শুধু খাবার আর একটু থাকার জায়গা হলে চলে না। সত্য কথা বলতে কী, পশু-পাখিদের মতো ছক বাঁধা বা একঘেঁয়েমির জীবন কোনো দরকার নেই। জীবনে আসবে নতুনত্ব, স্বপ্নে আসবে একটা আবেশ। পারিপার্শ্বিকতায় আসবে এক নতুন আমেজ ও ইমেজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু হবে পরিবর্তন এটা বিজ্ঞান বিশ্বাস করে। বিজ্ঞান মনেপ্রাণে চায় যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত আবহ। সব যেন এক ইশারাতেই হবে সুন্দর আর মধুময়। বিজ্ঞানের গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতেই তো প্রযুক্তির ঝান্ডা ওড়ে।

জীবনে থাকবে চ্যালেঞ্জ। থাকবে নানা প্রতিকূলতা। আর তা জয় আর ভালো থাকার জন্য নতুন নতুন কিছু আবিষ্কার করা যেন নেশাতে পরিণত। এখান থেকেই প্রযুক্তির ধারণা এসেছে। ধরা যাক, আমরা বাড়ির আসবাবপত্র যেমন চেয়ার, টেবিল, খাট, ড্রেসিং টেবিল বানাতে চাই। এক্ষেত্রে আপনার বাড়িতে একটা পুরানো ইয়া বড় একটা কাঁঠালগাছও আছে। তবে কী আর কোনো চিন্তাই নেই আপনি গাছ কেটে বানাতে লাগবেন। না, না তা তো হবে না। এক্ষেত্রে প্রথম একজন ওসব বানানোর জন্য জ্ঞান থাকা মানুষ লাগবে। দ্বিতীয়ত মানুষটির কাছে আসবাব বানানোর যন্ত্র লাগবে। এই যে যন্ত্রের প্রয়োগ এটাই তো প্রযুক্তি। অর্থাৎ অধীত জ্ঞান কাজে লাগানোর জন্য যেসব কৌশল ও যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয় একেই প্রযুক্তি বলে। আসলেই মানুষ তো কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে না শুধু রূপান্তর ঘটায় মাত্র। সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আসছে। পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জালানো। কিংবা চাকা আবিষ্কার সবই তো প্রযুক্তির বদৌলতেই। খাদ্য উৎপাদন, গৃহ নির্মাণ বলি আর পশু শিকার করাই যাই বলি না কেন সব জায়গাতে কিন্তু জ্ঞানের সবিশেষ প্রয়োজন হয়েছে। আগুন জ্বলে উঠল আর তা নেভানোর কৌশল কিন্তু মানুষ আপনা-আপিনই শিখেছে। এখানে প্রযুক্তির কোনো যোগ নেই। মানুষ মনের অজান্তেই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছে। তবে যাই বলি না কেন বিজ্ঞানের জ্ঞানের রাস্তা ধরেই প্রযুক্তির আসা। আগে প্রযুক্তি আসেনি। তবে প্রাচীনকালের মানুষের প্রযুক্তির ব্যবহার নিছক জীবন বাঁচাতে তবে তা আসলেই বিজ্ঞান হয়ে ওঠেনি। প্রাচীনকালে একভাবে চলেছে এখন সে ভাবনা নিয়ে বসে থাকলে তো আর চলে না। এখন সময়ের কাজ সময়ে করার প্রয়োজন বোধ থেকেই তো ঘড়ির উদ্ভাবন। মঙ্গলগ্রহের কথা শুনেই আমরা থেমে থাকতে খুশি নই। মঙ্গলের যাবতীয় তথ্য আজ মানুষের হাতে সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা চলছে সেখানে মানুষ বসবাস করতে পারে কিনা। একসময় হয়তো সেটাও সম্ভব হবে কিনা তা সময়ই বলবে। এখন আর হেঁটে বা গরু, ঘোড়ার গাড়িতে চলাচলা করলে চলে না। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল-মিলিয়ে চলতে হয়। তাই দরকার বাস, ট্রেন, জাহাজ আরও কত কি! সময়ের সঙ্গে পালস্না দেওয়াই যেন বিজ্ঞানের কাজ আর বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সামনের পাণে রুদ্ধশ্বাসে চলাই প্রযুক্তির মূল কাজ। পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে কী বল কাজ তার উপর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা আর প্রযুক্তিবিদরা তার ওপর নির্ভর করে কৃত্তিম উপগ্রহ স্থাপন করেছেন আকাশে। উদ্ভিদের গঠন, বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারের ওপর বায়ু, পানি, আলোসহ প্রকৃতির নানা উপাদান কীভাবে উদ্ভিদের উপরে ক্রিয়াশীল এর উপর ভর করে ফসল উৎপাদনের উন্নতি সাধন করেছে। বিজ্ঞান আমাদের জ্ঞান দেয়, প্রযুক্তি আমাদের কাজের গতি ত্বরান্বিত করে। আবার প্রযুক্তি শুধু বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল নয়, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা অনেক সময় বিজ্ঞানকেও হার মানায়।

এখন বিজ্ঞান যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রযুক্তির লাগাম ধরা যাচ্ছে না। ধরারও দরকার নেই। নতুন নতুন জ্ঞান আর নিত্য-নতুন আবিষ্কার আমাদের অনেক ক্ষেত্রে অলসও করে দিচ্ছে। সকালের চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া থেকে রাতের বিছানাতে যাওয়ার সময়ে লাইট বন্ধ করার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞান আমাদের নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। বিজ্ঞানের দেখানো পথেই তো প্রযুক্তি এগিয়ে যাচ্ছে।

গত একশ বছরে প্রযুক্তির যে বিস্তার তা আমাদের শুধু তাড়িত নয় ভাবিতও করেছে। রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন, কম্পিউটারসহ কৃষি, চিকিৎসা ও গবেষণাযন্ত্র। অবশ্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত তাড়াতাড়ি এত বিশাল প্রসারের বহু কারণও আছে। এখানে মানুষের প্রয়োজন বাড়ছে। অথচ স্থান কম। মানুষ বাড়ছে অথচ উৎপাদন কম তাহলে তো অনেক মানুষ না খেয়েই মরে যাবে। অবশ্য প্রযুক্তির এ উৎকর্ষতার যুগেও এখনো মানুষ না খেয়েও থাকে। বলতে দ্বিধা নেই, বিজ্ঞানের উন্নতির পাশাপাশি, প্রযুক্তির চঞ্চলতার সঙ্গে সঙ্গে আপামর জনগোষ্ঠী কী পরিবর্তন হতে পারছে? না, পারছে না। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানের উন্নতি আর প্রযুক্তির চলমানতার চিত্র খুব বেশি সুখকর না হলেও এখন অনেকেই প্রযুক্তির কাছে নিজেদের ধরা দিয়েছে। বিজ্ঞানের জ্ঞানের কাছে নতি স্বীকার করছে। বিজ্ঞানের অনন্ত উদ্ভাবন, নিরলস সৃষ্টিশীলতা, সৌন্দর্যকে ধরার সাধনা তা তো চলবেই। প্রযুক্তিও এগিয়ে চলবে বিজ্ঞানের দক্ষিণ দৃষ্টির সঙ্গে। মানুষ সবসময়ই নিজেকে বারবার অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। এ যাত্রা শেষ হওয়ার নয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে