শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের আবেগ যখন জিনের কারসাজি

জিন সার্কিটের ধারণা আণবিক জীববিজ্ঞানীরা এ ভাবনা থেকে এনেছিলেন, একটি ক্রোমোজোমের জিনগুলো এককভাবে কাজ করে না। বরং এদের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। এ সমন্বয় একটি কোষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমে অবস্থিত অসংখ্য জিনের মধ্যে হতে পারে। আরও সমন্বয় হতে পারে একটি কোষের বাইরে অন্য একটি কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ক্রোমোজোমের জিনগুলোর মধ্যে
রায়হান শাহরিয়ার
  ০৬ মার্চ ২০২১, ০০:০০

মানুষ হিসেবে আমরা অন্য মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই, মিশি, সম্পর্কিত হয়। এ সম্পর্কের মানুষের দিকে আমরা তাকাই। তাকানোর পর তার মনোভাব বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখাই। এই যে মানুষের মুখের দিকে তাকানো এবং তাকানোর পর অন্যের মনোভাব বোঝা এবং নিজের মধ্যে একটি উপলব্ধি আসা এ বিষয়টিও এখন বিজ্ঞানের গবেষণায় চলে এসেছে।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করে নিয়ে এসেছেন, মানুষের হাসোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পরিমাণের দিকটি জিনের সঙ্গে জড়িত। এ জিনটির নাম হচ্ছে ক্যানাবিনয়েড রিসেপ্টর জিন।

সূক্ষ্ণ এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় অটিজম রোগীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের তাকানোর ও মনোযোগের পার্থক্য তুলনা করলে। ক্যানাবিনয়েড রিসেপ্টর জিনটি অটিজম রোগীদের ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা পরিবর্তিত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী ড. বিসমাদেভ চক্রবর্তী ক্যানাবিনয়েড রিসেপ্টর জিন আবিষ্কার করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মস্তিষ্কের সন্তুষ্টি ও প্রাপ্তির অনুভূতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যতম জায়গা স্ট্রাটিয়াম নিয়ে কাজ করছিলেন। তার গবেষণা কার্যক্রমে অটিজম রোগটিও জড়িত ছিল। অটিজম রোগীরা অন্য মানুষের মুখের দিকে বেশিক্ষণ মনোযোগ দিতে পারে না। পাশাপাশি তারা অন্য মানুষের মুখ যে আবেগ প্রকাশ করে তা ধরতে পারে না। ফলে ড. চক্রবর্তী ও তার সহকর্মী গবেষকদের একটি অন্বেষা আগ থেকেই ছিল যে, একজন মানুষ অন্য মানুষের মুখের দিকে কত সময় তাকিয়ে থাকে, অন্যের মুখের মাঝে বিরাজমান আবেগ কতটুকু ধরতে পারে তার কোনো জেনেটিক ভিত্তি আছে কিনা। এ অন্বেষা থেকে তাদের যে দীর্ঘ গবেষণা তা-ই নতুন এ তথ্য উন্মোচনে সহায়তা করে।

জিন সার্কিটের ধারণা আণবিক জীববিজ্ঞানীরা এ ভাবনা থেকে এনেছিলেন, একটি ক্রোমোজোমের জিনগুলো এককভাবে কাজ করে না। বরং এদের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। এ সমন্বয় একটি কোষের ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমে অবস্থিত অসংখ্য জিনের মধ্যে হতে পারে। আরও সমন্বয় হতে পারে একটি কোষের বাইরে অন্য একটি কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ক্রোমোজোমের জিনগুলোর মধ্যে। এভাবে নির্মিত জিন সার্কিটে অস্বাভাবিকতা আসতে পারে সুনির্দিষ্ট একটি জিনে বা কয়েকটি জিনে সিকোয়েন্সের পুনর্বিন্যাসের জন্য। জিনের সিকোয়েন্স ভেঙে গেলেও এরূপ অস্বাভাবিকতা দেখা যেতে পারে।

জিন সার্কিটের এ অস্বাভাবিকতা ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঙ্গে জড়িত। পাশাপাশি জিনের সিকোয়েন্সে পরিবর্তনের কারণে ক্যান্সার জিন সক্রিয় হয়, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এ তথ্যটিও মাইক স্ট্রাটোন এবং অ্যান্ডি ফুট্রেয়ালের দৃষ্টি এড়ায়নি। ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এ রকম হতেই পারে।

বিআরসিএ-১ ও বিআরসিএ-২ জিনের পুনর্বিন্যাস এবং হেরাসিপটিন হরমোনের সঙ্গে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্পর্ক আছে এটা বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েক বছর হলো আবিষ্কার করেছেন। এ আবিষ্কারের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে মাইক স্ট্রাটোন ও অ্যান্ডি ফুট্রেয়ালের জিনোম পুনর্বিন্যাস বা জিন সার্কিট পুনর্বিন্যাসবিষয়ক আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে।

ব্রেকথ্রো ব্রেস্ট ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানী ড. জর্জ রেইস ফিলহো একে অসাধারণ ও উলেস্নখযোগ্য একটি আবিষ্কার হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ডিএনএ অণু কোনো কারণে ভেঙে গেলে তা আবার পুনরায় গঠিত হয়ে যায় জীববৈজ্ঞানিক স্বয়ংক্রিয় মেরামত প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে। এ মেরামত প্রক্রিয়া প্রায় সময়ই পুরনো জেনেটিক বিন্যাস ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিউটেশনের কারণে পুরনো জেনেটিক বিন্যাসে পরিবর্তন হয় তখন দেখা দিতে পারে অস্বাভাবিকতা। ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে বিআরসিএ-১ ও বিআরসিএ-২ জিনে ও হেরাসিপটিন হরমোন-সংক্রান্ত জিনে মিউটেশনের কারণে পুরনো জেনেটিক বিন্যাসে পরিবর্তন দেখা দেয়। ফলে তৈরি হয় ব্রেস্ট ক্যান্সার। তিনি আরও বলেছেন, বিজ্ঞানীদের এখন কাজ হলো এ মিউটেশনকে বা জেনেটিক পুনর্বিন্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে নারীরা তাদের সৌন্দর্য এবং মাতৃত্বের অন্যতম গঠনকে অক্ষত রাখতে পারবে।

মাইক স্ট্রাটোন ও অ্যান্ডি ফুট্রেয়াল আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে জিনোম পুনর্বিন্যাস বা জিন সার্কিট পুনর্বিন্যাসবিষয়ক ধারণা আরও উন্নত ও গভীর হবে এবং ব্রেস্ট ক্যান্সারের পাশাপাশি অন্যান্য ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও এ ধারণা কাজে লাগবে। মাইক স্ট্রাটোন ও অ্যান্ডি ফুট্রেয়াল চেষ্টা করছেন তাদের এ অর্জনকে কাজে লাগিয়ে ব্রেস্ট ক্যান্সারের স্থায়ী সমাধান বের করতে। তাদের এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিশিষ্ট আণবিক জীববিজ্ঞানী ওয়াল্টার সেনার। সেনার মন্তব্য করেছেন, আগামী ৫ বছরের মধ্যে মানুষ এ গবেষণার সুফল পাবে।

মানুষের একটি ক্রোমোজোমে সাধারণত একটি ডিএনএ অণু থাকে। সুনির্দিষ্ট ক্রোমোজোমে এ ডিএনএ অণুর পুনর্বিন্যাস বা ভেঙে যাওয়ার কারণে মানুষের শরীরে নানারকম অস্বাভাবিকতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ ব্যাপারটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে দেখা যায়। সুনির্দিষ্ট একটি ক্রোমোজোমে ডিএনএ অণুর পুনর্বিন্যাস বা ভেঙে যাওয়ার কারণে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়। এ ব্যাপারটি জেনেটিক পর্যায়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুস্পষ্ট ছিল না। বিজ্ঞানী মাইক স্ট্রাটোন এবং অ্যান্ডি ফুট্রেয়ালের আবিষ্কার জেনেটিক পর্যায়ে কী ধরনের পুনর্বিন্যাস ঘটে তা সুস্পষ্ট করেছে।

অন্যদিকে, বায়োলজিক্যাল সাইকিয়াট্রি নামক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধে গবেষক অ্যাডাম ডি. গোয়েস্টেলা এমন একটি হরমোনের উলেস্নখ করেছেন যেটি হ্যাপি ফেসের মেমোরি বাড়িয়ে দেয়। ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঙ্গে জড়িত জিন আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা তাদের সাফল্য বেশ আগেই দেখিয়েছেন। তারা আবিষ্কার করেছেন ব্রেস্ট ক্যান্সারের সঙ্গে জড়িত বিআরসিএ জিনগুলো। এখন যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন তা হচ্ছে এ জিনগুলোর উৎস খুঁজে বের করা এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার করা। এ অন্বেষা থেকে বিজ্ঞানীরা শুরু করেছেন জিন সার্কিট নিয়ে গবেষণা। কয়েক বছর ধরে জিন সার্কিট ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের মধ্যে যোগসূত্র বিষয়ে নানারকম নতুন তথ্য উন্মোচিত হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মধ্যে রয়েছে নারী আর পুরুষ এবং অনেক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমন্বিত রূপসহ নানারকম বৈচিত্র্য। এ বৈচিত্র্য বা বিভিন্নতা হরমোন নিয়ন্ত্রণকারী জিন সার্কিটের ফলাফল। এ সার্কিটের অস্বাভাবিকতা নারী-পুরুষ তথা মানুষের স্বাভাবিক সংগঠনে পরিবর্তন ঘটায়। নারীর সৌন্দর্য ও মাতৃত্বের অন্যতম গঠন ব্রেস্ট এবং জরায়ু অনেক ক্ষেত্রেই এ জিন সার্কিটের অস্বাভাবিকতার কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে