পরিপাকে সহায়তাকারী এনজাইমের রহস্য

প্রকাশ | ০৬ মার্চ ২০২১, ০০:০০

এ এন আলম
খাবার হজমের ব্যাপারটা নিয়ে মানুষের কৌতূহল সেই আদিমকাল থেকেই। শিকারি পশুর পাকস্থলীর খাবারই মানুষের এই কৌতূহলের কারণ। প্রাচীনকালের মানুষ জানত যে খাবার পাকস্থলীতে গিয়ে হজম হয়। তাই শিকার শেষে পশুর পাকস্থলীতে একবার না তাকিয়ে পারত না তারা। সেখানে খুঁজে পাওয়া যেত না কোনো খাবার। পাওয়া যেত দলাজাতীয় কিছু। মনে হতো খাবার রান্না হয়েছে। পাকস্থলীতে আসলে কী হতো, এটা পুরোপুরি জানতে মানুষের প্রায় হাজার বছর লেগেছিল। প্রাণিজগতের সদস্যদের শরীরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা দেখা যায় ৩৮-৪৩ সেন্টিগ্রেড, যা খাবার রান্নার জন্য যথেষ্ট নয়। পাকস্থলীতে গিয়ে খাবার হজম হয় ডাইজেস্টিভ জুসের মাধ্যমে যেখানে থাকে নানারকমের বিশেষ এনজাইম। মানুষ ও পশুর এলিম্যান্টারি ট্রাক্টকে একটা জটিল রাসায়নিক গবেষণাগারের সঙ্গে তুলনা করা চলে। খাবার খাওয়ার পর সেটা শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর সেই খাবারের সঙ্গে মেশে নানারকমের ডাইজেস্টিভ জুস। তারপর খাবার এক অংশ থেকে আরেক অংশে যাওয়া শুরু করে। এরপর শুরু হয় হজমের কাজ। এ সময়ে জটিল রাসায়নিক যৌগগুলো পরিণত হয় সহজ-সরল রাসায়নিক যৌগে, যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। শরীর যা হজম করতে পারে না বা যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় নয়, সেটা শরীর থেকে বের হয়ে আসে। মানুষের পাকস্থলীতে খাবার যে প্রক্রিয়ায় হজম হয়, সেটা সহজে বোঝা যায়নি বা ব্যাখ্যা করা যায়নি। এ ব্যাপারে রুশ বিজ্ঞানী পাভলভ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছেন। তিনিই প্রথম মানুষের প্রধান এলিম্যান্টারি গস্ন্যান্ডগুলো নিয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা চালান। তিনি দেখান যে, গস্ন্যান্ডের সংখ্যা অনেক। এ গস্ন্যান্ডগুলো বিশেষ বিশেষ খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় ডাইজেস্টিভ জুস উৎপন্ন করে। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ফলে খাবার কীভাবে হজম হয়, এ প্রশ্নের ওপর যে রহস্যময় পর্দা এতদিন ঝুলে ছিল, তা তিনি উঠিয়ে ফেলেন। খাবার হজমের প্রক্রিয়াটি তার পরও মানুষ পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। গবেষণাগারে টেস্ট টিউবে হজমের প্রক্রিয়াটি মানুষ ঘটাতে পারেনি। টেস্ট টিউবে প্রয়োজনীয় ডাইজেস্টিভ জুস মিশিয়ে খাবার হজম করা যায়নি। অথবা খাবার হজম হয়েছে, কিন্তু সময় লেগেছে অনেক। এ রহস্যের সমাধানে আবারও এগিয়ে এলেন রুশ বিজ্ঞানীরা। তারা খেয়াল করলেন যেসব খাবার ক্ষুদ্রান্ত্রের সংস্পর্শে আসে, সেগুলো খুব সহজেই হজম হয়। যেমন- প্যানে কোনো রান্না করতে গেলে দেখা যায় প্যানের সংস্পর্শে যে খাবার আসে সেটাই তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়। খাবারের চেয়ে প্যানের গায়ের তাপমাত্রা থাকে অনেক বেশি। কিন্তু ক্ষুদ্রান্ত্রের সেরকম তাপমাত্রা থাকে না। একটা পরীক্ষা করা হলো। একটা পশুর শরীরের ক্ষুদ্রান্ত্রের একটা অংশ কাটা হলো। তারপর সেটা রাখা হলো একটা টেস্ট টিউবে। টেস্ট টিউবে আগেই রাখা ছিল স্টার্চের মিশ্রণ ও অ্যামিলেইস। ফলে খাবার হজম দ্রম্নত হলো। এ পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হলো যে ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল খাবার হজমের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু কীভাবে? এবার এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হলো। অনেক গবেষণা হলো। কিন্তু সমাধান পাওয়া গেল আচমকা। ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালের গঠনের মধ্যে লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল বা উপরি অংশ তৈরি এপিথেলিয়াল সেল দ্বারা। এসব সেলে আছে প্রচুর পরিমাণ অতি ক্ষুদ্র শুট (ংযড়ড়ঃ)। প্রতিটি কোষে থাকে প্রায় ৩ হাজারের মতো শুট। এর ফলে ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়াল থেকে বের হয় প্রয়োজনীয় এনজাইম। আবার এসব কোষেই জমা থাকে প্রয়োজনীয় এনজাইম। খাবার হজমের প্রক্রিয়ায় এ এনজাইমগুলো ক্যাটালিস্ট হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ খাবার হজমের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এনজাইম না থাকলে খাবার হজম হতো অনেক সময় নিয়ে। ক্ষুদ্রান্ত্রের দেয়ালের যেসব জায়গায় এনজাইমের ঘনত্ব বেশি হয়, সেখানে খাবার দ্রম্নত হজম হয়। এনজাইমের সংখ্যা বেশি থাকে না; কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, একই ধরনের এনজাইম বারবার ব্যবহার করা যায়।