মহাকাশে ভয়েজার-১

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

এম সাইফুল
আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৭৭ সালে যাত্রা শুরু করেছিল মহাকাশযান ভয়েজার-১। এ মহাকাশযানটির যাত্রার শুরুর দিকে পযের্বক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন নাসার ৩০০ বিজ্ঞানী। এরপর ২০০৪ সালের আগেই এর গতিবিধির দায়িত্বে রাখা হয়েছে মাত্র ১০ জন বিজ্ঞানীকে। কারণ ভয়েজারের এখন আর কোনো বিপথগামী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এটি সৌরমÐলের সব কটি গ্রহের তথ্য সংগ্রহের নিধাির্রত মিশনের দায়িত্ব পালন শেষে সৌরজগতের বাইরে চলে গেছে। ভয়েজার এখন মহাজগতের যে এলাকা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তা সৌর প্রভাবমুক্ত। সেখানে গভীর মহাকাশের নিঃসীম অন্ধকারের শুরু। মূলত আমাদের সৌরজগতের বাইরে অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ ও বহিঃজগতের প্রাণের খেঁাজে ভয়েজার-ওয়ানের যাত্রা শুরু হয়েছিল, আন্তঃনাক্ষত্রিক সভ্যতার স্বপ্নদ্রষ্টা কালর্ সাগানের পরিকল্পনায়। বিজ্ঞানীদের এক হিসাব মতে মহাকাশের ওই সুদূরের ৫-১০% আলোকিত আর ৯০-৯৫% জায়গা অন্ধকার। তাই বলা হচ্ছে, ভয়েজার-১ এখন চলছে মহাকাশের সেই নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যে। ২০০৪ সালের তথ্যানুসারে ভয়েজার-১ ছিল সূযর্ থেকে ১৪০০ কোটি কিলোমিটার দূরে। পক্ষান্তরে ভয়েজার-২ ছিল ১ হাজার ১০০ কোটি কিলোমিটার) দূরে, যাকে ভয়েজার-১-এর টুইনও বলা হয়। বিভিন্ন কারণে সূযের্র গায়ে সৃষ্টি হয় প্রতিক্রিয়া, যাকে বিজ্ঞানীরা বলেন সৌরবায়ু। সৌরবায়ু প্রবাহিত হয় সূযর্পৃষ্ঠে বিস্ফোরণের ফলে। আার এই সৌর বিস্ফোরণের ফলে মহাকাশে নিঃসৃত হয় বিপুল পরিমাণে গ্যাস। ভয়েজার নভোযান সৌরপৃষ্ঠের বৃহত্তম বিস্ফোরণের তথ্য পাঠিয়েছিল ২০০৪ সালের এপ্রিলে। ওই বিস্ফোরণটি সূযের্ ঘটেছিল ২০০৩ সালের এপ্রিলে। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়া ভয়েজার পযর্ন্ত পেঁৗছাতে সময় লাগেছিল ৩৬৫ দিন বা ১ বছর। বিশ্বের এক নাম্বার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা ১৯৭৭ সালে এ মহাকাশযানটি পাঠিয়েছিল মাত্র ৫ বছরের মিশনে। কিন্তু তা ২৮ বছর পরে ২০০৫ সালে সৌরজগতের সীমা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। এ ২৮ বছরে ভয়েজার-ওয়ান ৯৩২ কোটি মাইল বা ১ হাজার ৫০০ কোটি কিলোমিটার মহাকাশীয় পথ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। প্রথমে বিজ্ঞানীরা এ পথে ভয়েজার-১-এর গতিবিধির ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন। কেননা টারমিনেশন শক এমন একটি এলাকা যেখানে মহাজাগতিক বস্তুগুলো নাক্ষত্রিক গ্যাস এবং অন্যান্য কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে এটার গতি খুবই কমে যায়। এ এলাকায় বাধাবিপত্তি অনেক বেশি। এতে শঙ্কার কারণ সৃষ্টি হয়েছিল। এ টারমিনেশন শক এলাকার পরেই রয়েছে বিজ্ঞানীদের ভাষায় হিলিওসহেলথ অঞ্চল। বিজ্ঞানীদের আগে ধারণা মিথ্যা করে দিয়ে ভয়েজার-১ তার প্রবল বেগে টারমিনেশন এলাকা অতিক্রম করেছে। টারমিনেশন শক হলো আমাদের সৌজগতের বাইরের একটি বিশেষ মহাকাশীয় এলাকা, যেখানে প্রচÐ বেগে সূযর্ থেকে ছুটে আসা কণিকাগুলোর গতি হঠাৎ করে থেমে যায়। এই ডিপ স্পেস হলো বিভিন্ন নক্ষত্রের মধ্যবতীর্ এলাকা, যা গ্যাসে ভতির্। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, টারমিনেশন শক এলাকা পার হওয়ার বড় প্রমাণ হলো সূযর্ থেকে আসা কণিকারাজির কারণে মহাকাশযানের চারদিকে চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তি অনেক বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্কেত পাওয়া গেছে। আর গতি অনেক কমে গেছে। এ দুটো তথ্য প্রমাণ করে যানটি টারমিনেশন শক এলাকা পার হয়ে গেছে। মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাথির্বজ্ঞানী প্রফেসর ডুনাল গ্রানেট বলেছেন, এই হোলিওহেলথ এলাকা পার হলেই যানটি সৌরজগৎ থেকে বের হয়ে যাবে। তবে ওই যানটি এখন দুটো নক্ষত্রের মাঝখানে চলমান রয়েছে। আমরা পৃথিবীতে যে বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি ওই এলাকার গ্যাস তার থেকে সম্পূণর্ আলাদা। এ গ্যাসের কারণে ওই মহাকাশযান থেকে অনেক মহাকাশীয় শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, আমরা ওই যান থেকে সম্ভবত ২০২০ সাল পযর্ন্ত তথ্য পাব। এরপর এর বিদ্যুৎশক্তিতে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে এটা পৃথিবী ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবে। আর সেখান থেকে পাঠানো সঙ্কেত দুবর্ল হয়ে যেতে পারে। শেষ পযর্ন্ত আমরা সেই সিগন্যাল থেকে তথ্য উদ্ধার করতে পারব না। তবে ২০৩০ সাল পযর্ন্ত ওই যানটা চলতে থাকলে শেষ পযর্ন্ত কোথায় গিয়ে পেঁৗছায়, সেই দূরত্ব আর স্থানটা বলা যাচ্ছে না। প্রথমে পরিকল্পনা ছিল ভয়েজার সৌর পরিবারের বাইরের দিকের গ্রহগুলোকে পযের্বক্ষণ করবে। শেষ পযর্ন্ত এটা সেখানেই থেমে থাকেনি। চলতেই থেকেছে দূর থেকে আরো মহাদূরে। তার গতিবেগ ক্রমাগত সামনের দিকে। তা এখন পেঁৗছেছে এই পৃথিবী থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি মাইল বা প্রায় ২ হাজার কোটি কিলোমিটার দূরে, সূযের্র চারপাশে ঘুরতে থাকা ৯টি গ্রহের সব কটিকে ছাড়িয়ে। এ মহাকাশযানটি এখন এতই দূরে চলে গেছে যে সেখান থেকে রেডিও সিগন্যাল পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে ১৭ ঘণ্টা। এই প্রথম মানুষের তৈরি কোনো মহাকাশযান সৌরজগতের বাইরে যেতে সক্ষম হয়েছে। সৌরজগতের বাইরে এই জগৎ হলো একটি তারা থেকে আরেকটি তারার মধ্যবতীর্ দূরত্ব, যাকে বিজ্ঞানীদের ভাষায় বলা হয় ইন্টার স্টারস স্পেস। ঠাÐা অন্ধকার মানব অভিজ্ঞতার বাইরের এক মহাকাশীয় জগৎ। ভয়েজার প্রজেক্টের একজন বিজ্ঞানী বলেছেন, এটা প্রথম চঁাদে অবতরণের মতোই এক ঐতিহাসিক তাৎপযর্পূণর্ ঘটনা। এর মাধ্যমে আমরা এক তারা থেকে আরেক তারার মধ্যে কী আছে তা জানার সুযোগ পেলাম। এক নাম্বার কথা হলো আমরা সেখানে পেঁৗছাতে পেরেছি। ৩৬ বছর আগে এটা যখন যাত্রা শুরু করেছিল, তখন আমরা আশা করেছিলাম সেখানে একদিন পেঁৗছাতে পারব। কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না সূযের্র বুদবুদ থেকে সৃষ্ট আমাদের সৌরজগৎ কত বড়। ভয়েজার যানটি তা অতিক্রম করার মতো দীঘর্ সময় টিকে থাকতে পারবে কি না? এর তথ্যউপাত্ত থেকে এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে এটা সৌরজগতের সীমা পার হয়ে গেছে। আসলে ভয়েজার সৌরজগৎ পার হয়ে গেছে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট। কিছু দিন থেকেই ভয়েজারের সেন্সর থেকে সঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছিল যে তার চারপাশের পরিবেশ বদলে গেছে। ২০১২ সালের নভেম্বর নাগাদ পাওয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে, ভয়েজারের বাইরে প্রতি কিউবিক মিটারে প্রোটনের সংখ্যা হঠাৎ করেই ১০০ গুণ বেড়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা আগেই ভেবেছিলেন এটা সৌরজগতের বাইরে গেলেই এর কম কিছু হতে পারে। এরপর বিজ্ঞানীরা কয়েব দফা হিসাব নিকাশ করে নিশ্চিত হলেন। ২০১২ সালের ২৫ আগস্টের দিকে ভয়েজার সৌরজগতের সীমা পার হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মহাকাশ গবেষণার ৫৫ বছরের মধ্যেই আমরা সৌরজগৎ পার হতে পেরেছি। ভয়েজারের চারদিকে এখন যে বস্তুকণা রয়েছে, তা সূযর্ থেকে সৃষ্টি নয়। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে আশপাশের তারা থেকে। সুপারনোভা বা বিস্ফোরিত তারার অবশিষ্ট বা অন্যান্য অংশ থেকে। বাস্তবিক অথের্ই ভয়েজার এখন অচেনা অজানা এক নতুন পরিবেশ ও জগতে রয়েছে। এর ছবি ও বাতার্ চালু থাকবে যত দিন এর বিদ্যুৎপ্রবাহ চালু থাকবে। তবে ধারণা করা হচ্ছে ১০ বছরের মধ্যেই তাও শেষ হয়ে যাবে। তখনো এই চ্যাম্পিয়ন মহাকাশযানটি চলতেই থাকবে ক্রমাগত সামনের দিকে।