নতুন শতাব্দীর বিজ্ঞান

প্রকাশ | ১৩ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

আলিজা ইভা
আমরা গড়ে তুলেছি একের পর এক বিশ্বজনীন সমৃদ্ধশালী নগরী। আমরা যখন আমাদের অজর্নগুলো নিয়ে গবির্ত বোধ করা শুরু করলাম ঠিক তখনই আমরা প্রকৃতির অপার শক্তি সম্পকের্ ধারণা পেলাম এবং বুঝতে পারলাম আমরা কিভাবে আমাদের নিজেদের ধ্বংস করছি। শতাব্দীর শুরুর দিকে মানুষ পৃথিবীকে “ইটোপিয়ার” মতো একটি অসা¤প্রদায়িক ও শান্তিপূণর্ স্বপ্নরাজ্য বানানোর আশায় বুক বঁাধে। সেখান থেকে মানুষ দেখতে শুরু করে মুক্তির স্বপ্ন। কিন্তু রাজনৈতিক নৃশংসতা আমাদের জন্য হুমকি হযে দঁাড়ায় ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে অনেক চড়া মূল্য পরিশোধ করতে হয় মানুষকে। বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক সহিংসতা আমাদের আতঙ্কিত করে তোলে যেখানে মৃত্যু ও গৌরব পাশাপাশি অবস্থান করে। আর এই সময়টাতেই সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে উচ্চৈস্বরে বারবার। নতুন শতাব্দীতে এসে বিশ্ব বিজ্ঞানের সুফল আর কুফলের অনেক কিছুই পযের্বক্ষণ করছে। জীবাণু অস্ত্র , পরমাণু বোমার রয়েছে নানারকম উৎকন্ঠা । আবার রোগের প্রতিকারে বিজ্ঞান রাখছে অপ্রত্যাশিত অবদান। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পৃথিবী প্রথম নিজে নিজেকে দেখা শুরু করল, আর ক্যামেরা ছিল সেই প্রথম পযের্বক্ষক যে এই নাটকীয় ১০০ বছর পযের্বক্ষণ করেছে। এটা ছিল এক প্রযুক্তিক উৎকষর্তার শতাব্দী। যন্ত্র, শক্তি ও যোগাযোগের এক অভূতপূবর্ সময় । এ সময় বিনোদন, খেলাধুলা, সঙ্গীত, ফ্যাশন জন্ম দেয় এক সাবর্জনীন সংস্কৃতির। নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও নিজেকে জাহির করার প্রবণতা যেন একটি সংস্কারে রূপ নেয় এ সময় এবং যুগটিও ছিল খ্যাতি, কুখ্যাতি, পরচচার্ ও আন্দোলনের । শেষ পযর্ন্ত আমাদের ইতিহাসটি কেমন হবে? কি রেখে যাব আমরা আমাদের উত্তরাধিকাদের জন্য? এমন প্রশ্ন মানুষের মনে দানা বঁাধতে শুরু করে। ততদিনে পৃথিবী তৈরি হচ্ছে পরবতীর্ শতাব্দীর জন্য যেখানে ভবিষ্যৎ ইতিহাসবিদরা সংরক্ষণ করবে বিংশ শতাব্দীর বহু অজানা তথ্য। কিন্তু আমরা কি আসলেই তৈরি হয়েছি পরবতীর্ অজানা পদক্ষেপের জন্য। যখন থেকে আমরা জানতে পারলাম সমতল দেখতে আমাদের এই পৃথিবী আসলে গোল তখন থেকেই মানুষ মেরুদ্বয় জয় করার চেষ্টা শুরু করল। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এখন এমন একটি সময় যেখানে একেবারে তরুণ প্রজন্মও ওইসব অঞ্চলে ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছে যেখানে একসময় মানুষের পদচিহ্নও পড়েনি। এখন অসংখ্য ভ্রমণকারী এই মেরুর ভয়ঙ্কর সৌন্দযের্র আকষের্ণ নয়তো বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কাজে মেরু ভ্রমণে আসেন। তারপরও কিছু মানুষ আছেন যারা নিজেদের সামথর্্য ও ক্ষমতা কতটুকু তা যাচাই করবার জন্য অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিককার বছরগুলো অভিযাত্রীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দুগর্ম অঞ্চলে অভিযান চালাত তাদের দেশের সম্মান বৃদ্ধির উদ্দেশে। এমনই একজন মানুষ ‘রবাটর্ পিয়েরী’। ১৯০৯ সালে তিনি সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত কাজটি করে দেখালেন। তিনি উত্তর মেরু জয় করলেন। পিয়েরী ছিলেন একজন আমেরিকান নাগরিক যিনি আমেরিকার উত্তর মেরু জয়ের প্রথম সম্মান পেলেন। তার কিছুকালের মধ্যে জানা যায় এমান্ডসন নামের আরেকজন অভিযাত্রী দক্ষিণ মেরুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছেন। এমান্ডসন সবসময়ই চাইতেন তিনিই প্রথম উত্তর মেরু জয় করবেন কিন্তু পিয়েরীর সফলতায় তিনি মনঃক্ষুণ হয়ে পড়েন। তখন মাত্র নরওয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে সুইডেনের কাছ থেকে । আর তখনই এমান্ডসন নরওয়েনদের এক নতুন জাতি হিসেবে গৌরবান্বিত করার জন্য তার এই অভিযান শুরু করেন । এমান্ডসন এই যাত্রার জন্য সাথে নিলেন “স্কি” তে দক্ষতাসম্পন্ন অভিযাত্রী এবং স্পেজের জন্য নিলেন কিছু কুকুর। অথার্ৎ তার অভিযাত্রী দল ছিল পূবর্ প্রস্তুতি সম্পন্ন। অন্যদিকে স্কট নিয়েছিলেন যন্ত্রচালিত মোটর স্পেজ যা মাঝপথেই অচল হয়ে পড়েছিল ফলে স্কটের অভিযান সেখানেই শেষ হয়। ১৯১১ সালের ১৪ জানুয়ারি পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এমান্ডসন দক্ষিণ মেরুতে পদাপর্ণ করলেন। তার একমাস পর যখন স্কট ও তার দল দক্ষিণ মেরুতে পেঁৗছল তাদের স্বাগত জানাল একটি নরওয়েন পতাকা। অসুস্থ , দুবর্ল, ক্ষুধাতর্ ও পরাজিত অবস্থায় ফিরতি যাত্রায় স্কট ও তার দলের করুণ মৃত্য ঘটে তঁাবুতে ঠাÐায় জমে। অন্যদিকে এমান্ডসন নরওয়ে ফিরে জাতীয় বীরের সম্মানে ভূষিত হন। এই ঘটনার প্রায় ৯০ বছর পর নরওয়েন অভিযাত্রীদের সেই বীরোচিত ঐতিহ্যের ধারা বজায় রেখে এরলিন কোগে নামে আরেক অভিযাত্রী দক্ষিণ মেরু জয়ে এগিয়ে যান। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সম্পূণর্ একা ও প্রায় অভুক্ত অবস্থায় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিক‚ল ও বিপদসঙ্কুল পরিবেশ জয় করেন। ১৯ শতকের গোড়ার দিকের কথা পবর্ত আরোহণ তখন একটি তুমুল জনপ্রিয় আউটডোর বিনোদনে পরিণত হয়েছে। মানুষ তার সামথর্্য পরীক্ষার জন্য পৃথিবীর প্রায় সব গুরুত্বপূণর্ পবর্ত আরোহণ করে। নতুন নতুন অভিযাত্রার জন্যে ইউরোপীয় অনুসন্ধানী দল শুধুমাত্র ইউরোপে নয় তারা অভিযান চালায় এশিয়া এমনকি দক্ষিণ আমেরিকাতেও। “কেন আমরা পবর্ত আরোহণ করি?” এই প্রশ্নের ঐতিহসিক উত্তর দিয়েছিলেন জর্জ মেলোরী ১৯২২ সালে। ১৮৫৬ সালে হিমালয় পবর্ত শ্রেণীতে পিক ১৫ নামে একটি শৃঙ্গ নিধার্রণ করেন ব্রিটিশ অনুসন্ধানী দল যা পৃথিবীর সবোর্চ্চ শৃঙ্গ। এই শৃঙ্গটি তীব্বতীয়দের কাছে পৃথিবীর মা “চুম্বালুম্বা দেবী” হিসেবে পরিচিত । একে আবার নতুন করে পরিচিত করিয়ে দেন ব্রিটিশ অনসন্ধানকারী ও জরিপকারী স্যার জজর্ এভারেস্ট। (যার নামে পরবতীের্ত এই পবর্তমালার নামকরণ করা হয়।) আফ্রিকাকে ততদিনে জানা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে মেরু বিজয় কিন্তু এভারেস্ট তখনও রয়ে গেছে অজেয় । এভারেস্ট জয়ের প্রথম প্রচেষ্টা নেয়া হয় ১৯২১ সালে। আর তৃতীয় ব্রিটিশ অভিযান চালানো হয় ১৯২৪ সালে।এভারেস্টের চূড়ায় পেঁৗছানোর প্রথম উদ্যোগ নেন এন্ডু অরভিন এবং জজর্ মেলোরি নামে দুজন অকুতোভয় অভিযাত্রী। সেবারই প্রথম এভারেস্ট অভিযানে অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়। শীষর্ চূড়ায় পেঁৗছানোর নিধাির্রত সময়ের ৫ ঘণ্টা আগে তাদের শেষবারের মতো দেখা গিয়ে ছিল । সে সময় প্রচÐ ঝড় বইছিল। একমাত্র এভারেস্টই জানে তারা তাদের লক্ষ্যে পেঁৗছাতে পেরেছিল কিনা। এরপর ১৯৫৩ সালে একটি ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল কনের্ল জন হান্টের নেতৃত্বে অভিযান চালায় এভারেস্টে। সেবারই প্রথম কোন দল শীষর্ চূড়ার এত কাছে পেঁৗছতে পেরেছিল প্রায় ১০০ মিটারের মধ্যে। দ্বিতীয় দলটির নেতৃত্বে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের “এডমন্ড হিলারি” এবং “তেনজিং নরগে” তিনি ছিলেন একজন নেপালি শেরপা। (শেরপা একটি নেপালি গোত্র যারা পবর্ত আরোহণ করে) তেনজিং ছিলেন পবর্ত আরোহণে সেই সময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। সেটা ছিল তার পঞ্চম বারের মতো এভারেস্ট যাত্রা । ১৯৫৩ সালের ২৯ মে তারা পৃথিবীর সবোর্চ্চ শিখরে পা রাখলেন । এরপর ফিরে এলেন বীরের বেশে। পরে হিলারী বলেছিলেন “এমনকি বিপদের আশঙ্কা থাকলেও সবোর্চ্চ শৃঙ্গ জয় মানুষের ক্ষমতার বাইরে নয়”। ১৯৭৭ সালে ইতালিয়ান আরোহী রাইনহোল্ড মেসনার একটি সাধারণ বিমানে চড়ে কোনো ধরনের অক্সিজেনের যন্ত্র ছাড়াই এভারেস্টের ওপর দিয়ে উড়ে যান । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন য়ে অক্সিজেন ছাড়াই তিনি এভারেস্ট জয় করবেন। তিনি চেয়েছিলেন সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিতে কম সরঞ্জাম নিয়ে সবোর্চ্চ শৃঙ্গে পেঁৗছবেন সবচেয়ে দ্রæততম সময়ের মধ্যে। তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। কিন্তু সে সময় এভারেস্টে অক্সিজেন ছাড়া আরোহণ করা অসম্ভব ছিল । তা সত্তে¡ও মেসনার এবং তার জামার্ন সঙ্গী এভারেস্ট আরোহণ করলেন। তারা এমনই এক মৃত্যু উপত্যকায় প্রবেশ করেছিলেন যেখানে বাতাসে খুবই কম পরিমাণে অক্সিজেন থাকার কারণে মস্তিষ্ক অকেজো হওয়ার আশঙ্কা ছিল । ন্যানো , রোবো থেকে শুরু করে সাইবার বিপ্লব ভবিষ্যতের বিজ্ঞানকে নিয়ে যাবে অন্য মাত্রায়।