মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্ব

প্রকাশ | ০৫ জুন ২০২১, ০০:০০

আলম আশরাফ
মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্ব! যেহেতু কালের শুরুই মহাবিস্ফোরণ থেকে তাই মহাবিস্ফোরণের আগে কিছুই ছিল না। কিন্তু এই কিছু না থাকাকে অনেকে ভুল করে থাকেন কোনো শূন্যস্থান হিসেবে। অথচ এটা ভেবে নেওয়াটাই ভীষণ ভুল। যেহেতু আদি বিস্ফোরণের আগে স্থানও ছিল না। এতক্ষণ তো শুধু বক বক করলাম যেটা নিয়ে লেখা তার কথা তো কিছু বলাই হলো না তাহলে শুরু করি জর্জ গ্যামোর বিখ্যাত তত্ত্ব বিগব্যাং নিয়ে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির একটি তত্ত্ব বিশেষ। এ তত্ত্ব অনুসারে ১৫০০ কোটি বছর আগের কোনো এক সময় একটি বিশাল বস্তুপিন্ডের বিস্ফোরণের ফলে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী জর্জ লেমিটর এ তত্ত্ব প্রথম প্রকাশ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে জর্জ লেমিটর এ তত্ত্ব প্রকাশ করলেও এই তত্ত্বকে বিস্তৃত করেন জর্জ গ্যামো। এখন লেমিটরের মতে সৃষ্টির আদিতে মহাবিশ্বের সব বস্তু আন্তঃআকর্ষণে পুঞ্জীভূত হয় এবং একটি বৃহৎ পরমাণুতে পরিণত হয়। এ পরমাণুটি পরে বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। এ মতবাদকে সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন এডুইন হাবল। হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমান্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। তার মতে, আদিতে মহাবিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর দূরে সরে যাওয়ার আচরণ বিগব্যাংই সমর্থন করে। ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তির উৎস হিসেবে যে আদি মহাবিস্ফোরণের (ইরম ইধহম) কথা বলা হয়ে থাকে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে তিনটি পর্যবেক্ষণলব্ধ কারণ দর্শানো হয় যে প্রধান ও প্রথম কথা হলো আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারিত হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- মহাবিশ্বের সবদিকে ছড়িয়ে থাকা একটি সমসত্ত্ব তাপীয় বিকিরণের অস্তিত্ব যা আসলে মহাবিস্ফোরণের মুহূর্তে উদ্ভূত প্রচন্ড তাপের ভগ্নাবশেষকে ব্যাখ্যা করে। আর তৃতীয়টি হলো- মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা রাসায়নিক মৌল এবং যৌগের তুলনামূলক আধিক্য যাদের সৃষ্টি হয়েছে মহাবিস্ফোরণের পরবর্তী অতি উত্তপ্ত ঘনীভূত পর্যায়ে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে। কী কারণে সেই আদি বিস্ফোরণ ঘটেছিল? সেই বিস্ফোরণের কেন্দ্র কোথায়? আমাদের ব্রহ্মান্ডের প্রান্তই বা কোথায়? মহাবিস্ফোরণ কেন একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়ে যায়নি? প্রশ্নগুলোকে মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে যথেষ্ট উপযুক্ত বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু সত্যি কথাটি হলো এ প্রশ্নগুলো মহাবিস্ফোরণ সম্পর্কে যথেষ্ট ভুল একটি চিত্র তুলে ধরে। তাই সবার প্রথমে ধারণা করতে হবে মহাবিশ্বের প্রসারণ বলতে আসলে কী বোঝায়। এটা নিশ্চয়ই বোঝায় না যে ছায়াপথগুলো একটি বিস্ফোরণ থেকে প্রাপ্ত বেগের কারণে পরস্পর থেকে দূরে, বহুদূরে শূন্যের মধ্যে ছুটে যাচ্ছে; বরং ছায়াপথগুলোর পরস্পরের মধ্যবর্তী স্থানগুলোই প্রসারিত হচ্ছে। স্থান যে এভাবে সঙ্কুচিত বা প্রসারিত হতে পারে তা বহু পরীক্ষিত আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব্বের একটি প্রধান অনুসিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থান-কাল কোনো অবিনশ্বর স্থির ক্ষেত্র নয় বরং মহাকর্ষ দিয়ে প্রভাবিত কোনো অঞ্চল। স্থান-কাল জ্যামিতিতে এ ধরনের অঞ্চলকে বলা হয় বক্রতা (ঈঁৎাধঃঁৎব)। আর বক্রতা ঘটে যখন মহাকর্ষের প্রভাবে স্থান এবং কাল একই সঙ্গে বেঁকে যায়। আদিতে মহাকাশের বস্তুপুঞ্জ বিক্ষিপ্তাকারে ছড়ানো ছিল। অবশ্য এই আদি বস্তুপুঞ্জ কীভাবে সৃষ্টি হয়েছিল এবং এগুলোর বিন্যাস কী রূপ ছিল, তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা দিতে পারেন নাই। বিগব্যাং তত্ত্বানুসারে প্রায় ১৫০০ কোটি বছর আগে এসব বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলো আন্তঃআকর্ষণের কারণে পরস্পরের কাছে আসতে থাকে এবং ধীরে ধীরে একটি ডিমের আকার ধারণ করে। বিজ্ঞানীরা একে নামকরণ করেছেন মহাপরমাণু (ঝঁঢ়ঢ়বৎ অঃড়স)। উলেস্নখ্য, এ সময় কোনো স্থান ও কালের অস্তিত্ব ছিল না। অসীম ঘনত্বের এ মহাপরমাণুর ভেতরে বস্তুপুঞ্জের ঘন সন্নিবেশের ফলে এর তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল- যে কোনো পরিমাপ স্কেলের বিচারে ১০১৮ ডিগ্রি। এভাবে বিস্ফোরণের ফলে যে বিকিরণের (ৎধফরধঃরড়হ) সৃষ্টি হওয়ার কথা, তার অস্তিত্ব প্রথম দিকে প্রমাণ করা যায়নি। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। ১৯৬৪ সালে অৎহড় চবহুরধং এবং জড়নবৎঃ ডরষংড়হ নামক দুজন বিজ্ঞানী বিকিরণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। ফলে বিগব্যাং-এর ধারণা আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বকেই সত্য বলে বিবেচনা করা হয়। \হএই তাপমাত্রা পরে আরও কমে গেলে দুর্বল নিউক্লীয় বল ও বিদু্যৎ-চুম্বকীয় বল পৃথক হয়ে যায়। এ সময় কোয়ার্কগুলো সবল বলের প্রভাবে আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টি করে ফোটন, প্রোটন এবং নিউট্রন। সব মিলিয়ে যে বিপুল বস্তুকণার সমাবেশ ঘটেছিল, সেগুলো প্রচন্ড গতিতে বিগব্যাং-এর কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। এ সময় এসব কণিকাও ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। ক্রমে ক্রমে এগুলো শীতল হতে থাকল এবং এদের ভেতরের আন্তঃআকর্ষণের কারণে কাছাকাছি চলে এসেছিল। ফলে বিপুল পরিমাণ বস্তুপুঞ্জ পৃথক পৃথক দল গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল। এ পৃথক দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে পত্তন ঘটেছিল গ্যালাক্সির (এধষধীু)। আমাদের সৌরজগৎও এরূপ একটি গ্যালাক্সির ভেতরে অবস্থান করছে। এই গ্যালাক্সির নাম ছায়াপথ (গরষশু ডধু)। এই সব ধারণা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বিশ্লেষণধর্মী লেখা ছাপা হয়। সেটার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে চলছে নতুনতর গবেষণাও।