শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন

সাজেদুর আবেদীন শান্ত
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০

মোহম্মাদ আশরাফুজ্জামান আশরাফ, জন্ম ১৯৯৮ সালের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার যাদবপুরে। মা সাযরা জামান ও বাবা মৃত আসাদুজ্জামানের সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে আশরাফ পঞ্চম। আশরাফ শার্শা পাইলট হাইস্কুল থেকে জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্সে (ভোকেশনাল) জিপিএ ফাইভ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর তিনি যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ২০১৯ সালে ডিপেস্নামা শেষ করেন।

আশরাফ জীবনের গল্প বলতে গিয়ে বলেন, 'আমার জীবনের গল্পটা শুরু হয় সেই জন্মের আগে থেকে। আম্মু বলতেন তুই পেটে থাকতে দুজনই মারা যা"িছলাম। আমি পেটে থাকাকালে অনেক বড় একটা আঘাত পেয়েছিল আম্মু। চিকিৎসাসেবায় ও আলস্নাহর রহমতে আমরা দুজনই বেঁচে যাই এবং জন্মের দিনেই আমি পুরস্কার অর্জন করি। ওই সময় আমি যে হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করি সেই হাসপাতালে বা"চাদের শরীর স্বাস্'্য ভালো হলে এক কথায় মোটাতাজা ও ওজনের দিক থেকে এগিয়ে থাকলে তাদের পুরস্কৃৃত করা হতো। আমার শরীর স্বাস্'্য ও ওজন ঠিক থাকাতে আমি পুরস্কারটি পাই'।

আশরাফ খুব ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রপাতি নিয়ে পড়ে থাকতে ও ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালোবাসতেন। তিনি যখন ৮ম শ্রেণিতে পড়ে, তখনই মোটামুটি ইলেক্ট্রনিক্স ও ইলেক্ট্রিক্যালের প্রিন্সিপাল মোটামুটি শেখা হয় তার। আশরাফের স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার। কিন্' ২০০১ সালে তার বাবা মারা যাওয়ায় তাদের এত বড় সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়। তাই অর্থাভাবে সাইন্স নিয়ে পড়া হয়নি তার। গ্রামের পাশেই শার্শা ভোকেশনাল পাইলট হাইস্কুলে ধার-দেনা করে ১৬৫০ টাকা দিয়ে জেনারেল ইলেক্ট্রিনিক্স বিভাগে তার মা তাকে ভর্তি করে দেন।

আশরাফ বলেন, 'আমি সবসময় বিল গেটসের একটা উক্তিতে বিশ্বাসী ছিলাম তা হলো 'তোমার মন যা চায়, তুমি তাই করো'। তাই আমার মন যখন যা চেয়েছে, তাই করেছি। কিন্' সমাজ আমাকে এত ছোট করল, ভোকেশনালে ভর্তি হয়ে যেন মহা অন্যায় করেছি। অনেকেই বলত ভোকেশনালে ভর্তি হয়ে সাইকেলের মিস্ত্রি ছাড়া আর কিছু হতে পারবে না। তবে আমার মা আমাকে সাহস জোগাতেন। বলতেন, যে কোনো শিা কোনোদিন ছোট হতে পারে না। এই কথাটাই আমার অনুপ্রেরণা জোগায়। ওই কথাটা মনে রেখে শুরু হলো নতুন চ্যালেঞ্জ'।

কাস নাইন থেকেই আশরাফ অ্যাডভান্স লেভেলের সার্কিট অটোমেশন ডিভাইস বানাতে শুরু করেন। এসএসসি শেষ হওয়ার পর সবাই ভর্তি পরীার জন্য কোচিং করত কিন্' তিনি কোচিংয়ে যেতে পারত না কারণ টাকার অভাব। তবে তিনি বাসায় ভর্তি পরীার জন্য পড়ালেখা চালিয়ে যেতেন। কিন্' ভাগ্যক্রমে ২০১৫ সালে বিটিইবি বোর্ড ঘোষণা করেন যে এবার ভর্তি পরীা হবে না। এর পরিবর্তে এসএসসি পরীার রেজাল্ট কোটার মাধ্যমে অটোমেটিক যাচাই-বাছাই করে ভর্তি হওয়া যাবে। ভাগ্যের খেলে আশরাফ নিজের স্বপ্নের সাবজেক্টে ইলেক্ট্রিকাল ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হোন।

এরপর শুরু হয় আশরাফের নতুন যাত্রা। কলেজের কাস শুরু হওয়ার পর সবাই যখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত তখন তার দিন কাটে যন্ত্রপাতির সঙ্গে। হঠাৎ একদিন আশরাফ কলেজের নোটিশ বোর্ডে দেখেন স্কিল কম্পিটিশন নামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে কানাডা স্টেপ প্রকল্প। তখনই তিনি চিন্তা করেন, তিনি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে এবং তা স্যারদের বলেন। স্যারেরা আশরাফের কথা শুনে অবাক হোন ভাবেন, প্রথম সেমিস্টারের ছাত্র কম্পিটিশন করবে? পারবে তো? এ সব ভাবতে থাকে। তিনি একমাত্র প্রথম সেমিস্টারের ছাত্র যিনি কম্পিটিশনে নাম লিখিয়েছেন। আশরাফের শুরু হলো বিচিত্র এক গবেষণার নেশা। প্রথম সেমিস্টারে তার প্রথম প্রজেক্ট ছিল অটোমেটিক ডোর লক অ্যান্ড সিকিউরিটি সিস্টেম। সেই প্রজেকটি তিনি সম্পন্ন করলেও কোনো মার্কস পাননি। প্রতি বছর অন্তর একটা করে কম্পিটিশন হয়। পরবর্তী বছরের জন্য প্রস্'তি নেয় আশরাফ। পরবর্তী বছরের প্রজেক্ট ছিল অটোমেটিক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। এটাও আশরাফ সফলভাবে সম্পন্ন করেন এবং প্রথম স্'ান অর্জন করেন।

এরপর ২০১৭ সালে কম্পিটিশনের জন্য তার প্রজেক্ট, ইনস্টিটিউট লেভেলে প্রথম স্'ান, আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রথম স্'ান ও জাতীয় পর্যায়ে ৭ম হন। পরে কানাডা থেকে বিচারকরা আসেন প্রজেক্ট দেখতে, এরপর এই প্রকল্প নিয়ে শুরু হয় তার নতুন আশা। এরপর ডিপেস্নামা চতুর্থ বছর মাল্টিপারপাস এগ্রিকালচার ফ্যাসিলিটিস প্রকল্পটি তৈরি করে ইনস্টিটিউট লেভেলে প্রথম স্'ান, আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রথম স্'ান ও জাতীয় পর্যায়ে সেরা দশের মধ্যে ৭ম স্'ান অর্জন করেন আশরাফ। ২০১৮ সালে 'আবিষ্কারের খোঁজে' অনুষ্ঠানে আশরাফের প্রকল্পটি সেরা দশে জায়গা করে নেয়।

এরপর ২০১৮ সালের চতুর্থ জাতীয় উন্নয়ন মেলায় বাংলাদেশ কারিগরি ও মাদ্রাসা শিা বিভাগ ও শিা মন্ত্রণালয়ের হয়ে আশরাফ নতুন প্রকল্প নিয়ে কম্পিটিশন করেন তা হলো 'বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম'। এ প্রকল্পটি জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় স্'ান অর্জন করেন এবং জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ তৃতীয় হয় ও বিশেষ পুরস্কার পায়। আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০১৯ এ আশরাফের প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি স্বচে দেখেন।

এ ছাড়া ২০১৮ সালে আইডিইবি আইসিটি ইনোভেশন এক্সপো এবং গণভবনে জাতীয় সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন আশরাফ। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি থেকে তাদের প্রকল্পটি 'বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম' অনুমোদন প্রাপ্ত হয়। তখনই শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে প্রকল্পটির প্রসার। ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২১ এ নির্বাচিত হয় আশরাফের প্রকল্প 'বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম'। তার এই উদ্ভাবন বাংলাদেশসহ প"থিবীর বিভিন্ন দেশের সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করবে।

আশরাফ ২০২০ সালে যশোর রিসার্চ ল্যাব নামে বিজ্ঞান কাব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাইবার টিনস অ্যাপ এ হেড অফ ডেভেলপার হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৯ সালে তিনি ছয় মাসের জন্য আইসিটি ডিভিশনের অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং করেন।

বাংলাদেশে প্রথম রান্না করা রোবট 'সুরুচি কুকিং রোবটে'র আন্ড্রয়েড ও ওয়েব ডেভেলপার হিসেবে কাজ করেছেন আশরাফ। পরে সেই রোবটটি উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। করোনাকালে যশোর জেলায় ভলেন্টিয়ার হিসেবে আশরাফ জেলা প্রশাসককে অনলাইন পশুর হাট সফটওয়্যারটি তৈরি করে দেন।

আশরাফ তার প্রকল্পের কাজ ও বিভিন্ন কাজ পরিচালনা করার জন্য 'সাইকোন' নামে একটি টিম গঠন করেন। সাইকোন টিমের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন আশরাফ। ইতিমধ্যেই তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এরমধ্যে অন্যতম হলো- চলো জিপিএস ট্র্যাকার, চলো ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি, চলো শপ, চলো আইটি, চলো আইটি ট্রেনিং সেন্টার ইত্যাদি।

আশরাফ বলেন, 'বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম প্রকল্পটির মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য বাংলাদেশের সব যানবাহনে আমাদের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাই। এ প্রকল্পের পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য ডিজিটালি ও টেকনোলজির মাধ্যমে কাজ করতে চাই এবং আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে চাই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে