জিনের সমন্বিত কাযর্ক্রম

প্রকাশ | ২৪ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

আলীজা ইভা
এমইসিপি-২ জিনে মিউটেশন বা পরিবতর্ন হলে রেট সিনড্রোম হয়ে থাকে ছবি : ইন্টারনেট
মানসিক প্রক্রিয়ায় জিনের ভ‚মিকা নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে হুদা জোগবির অবস্থান শীষের্। মানসিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু জিন আবিষ্কার করে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন এই বিজ্ঞানী। আমেরিকা ও ইউরোপে অথার্ৎ পশ্চিমা বিজ্ঞানসচেতন বিশ্বে হুদা জোগবি নামটি বিশেষ দৃষ্টিতে দেখা হয়। আমাদের দেশে শিক্ষা ও জ্ঞানকে ভালোবাসে যে নারীরা তাদের জন্য হুদা জোগবি অনুসরণীয়। সম্প্রতি আমেরিকার হাওয়াডর্ হুজেস মেডিকেল ইনস্টিটিউটে আণবিক জীববিজ্ঞান আর স্নায়ু জীববিজ্ঞান নিয়ে গুরুত্বপূণর্ একটি বক্তৃতা দেন। এতে সামাজিক বিবতর্ন, অটিজমসহ মানসিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বেশ কিছু গুরুত্বপূণর্ বিষয় উঠে আসে। হুদা জোগবি লেবাননের বৈরুতে তার পুরো শিক্ষাজীবন কাটান। মধ্যপ্রাচ্যের এ শহর তিনি কখনো শান্ত দেখেননি। গোলাগুলি, বোমা নিক্ষেপের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ওখানে মানুষ বসবাস করে। স্কুল ও কলেজ পযার্য় শেষ করে যখন তিনি মেডিকেলে পড়া শুরু করলেন, তখন লেবানন বহিঃশত্রæর আক্রমণ আর গৃহযুদ্ধের তাÐবে অস্থির। এ অস্থিরতা বৈরুত শহরে সবচেয়ে বেশি। হুদা জোগবি বলেন, ‘তখন আমাদের আশঙ্কা থাকত এই বুঝি ঘরের ওপর বোমা পড়ল। মেডিকেল কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। একধরনের অনিশ্চয়তা চারদিকে।’ এ সময় জীবনে সাহস জোগালেন বন্ধু-সহপাঠী আহলান। এ আহলানকেই পরে তিনি বিয়ে করেন। বৈরুতের অস্থিরতা একসময় কমে আসে। তবে শেষ হয় না। এর মধ্যে মনে দানা বেঁধেছে আরেক স্বপ্ন। বিজ্ঞানী হবেন। আণবিক জীববিজ্ঞান আর স্নায়ু জীববিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করবেন। আসলে এ স্বপ্নের পেছনে কাজ করেছিল মানবিকতা বোধ। চারপাশে এত ধ্বংস দেখে সৃষ্টিশীল কিছু করতে ইচ্ছা করছিল, এমন কাজ যা চিকিৎসাসেবাকে ছাপিয়ে মানব জাতির জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। হুদা জোগবি কাজ করেছেন রেট সিন্ড্রোম নিয়ে। রেট শব্দটি এসেছে ভিয়েনার শিশু বিশেষজ্ঞ রেট ওয়ারনিকের নাম থেকে। মেয়ে শিশুদের এ রোগটি হয়ে থাকে। এক্স ক্রোমোজোমে অবস্থিত এমইসিপি-২ জিনে মিউটেশন বা পরিবতর্ন হলে রেট সিনড্রোম হয়ে থাকে। মটরস্নায়ুতে বিশেষ করে হাতের মটরস্নায়ুগত ত্রæটি এবং সামাজিক সম্পকর্গুলো পরিমাপে ব্যথর্তা ফলস্বরূপ এক ধরনের নিঃসঙ্গতা হচ্ছে রেট সিনড্রোম রোগের লক্ষণ। তাই হুদা জোগবি আবিষ্কৃত এমইসিপি-২ জিনের পরিবতর্ন অটিজমের সঙ্গে সম্পকর্যুক্ত। হুদা জোগবি বলেন, এমইসিপি-২ জিন সামাজিক সম্পকর্গুলো অনুযায়ী কীভাবে আচরণ করতে হবে তার সঙ্গে সম্পকর্যুক্ত। মানুষের সামাজিক সম্পকর্গুলোর তাৎপযর্ উপলব্ধি মানব জাতির শিক্ষার ইতিহাসে অন্যতম একটি অজর্ন। এ উপলব্ধি সাংস্কৃতিক বিবতের্নর ফলাফল। সাংস্কৃতিক বিবতের্নর সঙ্গে পরিবেশ এবং জিনের সম্পকর্ নিয়ে হুদা জোগবি প্রবন্ধ লিখেছেন। সে প্রবন্ধও বিজ্ঞানের ইতিহাসে অন্যতম অজর্ন। হুদা জোগবি আণবিক জীববিজ্ঞান এবং স্নায়ু জীববিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান বেশ কিছু গুরুত্বপূণর্ পুরস্কার জিতেছেন। রেট সিনড্রোম, এমইসিপি-২ জিন ও অটিজমের মধ্যে সম্পকর্ স্থাপনের জন্য আমেরিকার জাতীয় বিজ্ঞান কাউন্সিল তাকে গত ৫০ বছরের মধ্যে অন্যতম সেরা নারী বিজ্ঞানী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। লেবাননের মতো অস্থির একটি দেশে পড়াশোনা শুরু করে এত বড় বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা নবীন নারী শিক্ষাথীের্দর জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। হেলেন ফিশার : প্রেমের বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় বিখ্যাত প্রেমের নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নাম হেলেন ফিশার। প্রেম বিষয়ে বিজ্ঞান প্রবন্ধ, বই, সাক্ষাৎকার ছাপিয়ে এবং বক্তৃতা প্রদান করে হেলেন ফিশার প্রেম বিশেষজ্ঞ হিসেবে তার যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। হেলেন ফিশার বড় হয়েছেন চারপাশের মানুষকে পযের্বক্ষণ করে করে। তিনি বলেন, মানুষ এবং তার বিচিত্র আচরণ ছোটবেলা থেকেই তাকে বেশ ভাবাত। তিনি চারপাশের মানুষকে, তাদের সম্পকের্র প্যাটানর্গুলোকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করতেন। এ চচার্টাই তাকে নৃবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী যা-ই বলা হোক না কেন, তা হতে সাহায্য করেছে। তিনি যখন দেখলেন মানুষের মাঝে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী স¤পকর্ হচ্ছে প্রেম, তখন প্রেমকেই একপযাের্য় গবেষণার অন্যতম বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিলেন। হেলেন ফিশার দেখিয়েছেন কোনো মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার মস্তিষ্কে কী ধরনের হরমোন এবং স্নায়বিক বিন্যাস কাজ করে। মস্তিষ্কের কোন সুনিদির্ষ্ট গঠন আর নিউরোট্রান্সমিটারগুলো প্রেমের সঙ্গে জড়িত, তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হেলেন ফিশার গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন। মানুষের প্রেম এক ধরনের আবেগ। এ আবেগের মস্তিষ্কগত সংগঠন এবং এর বহিঃপ্রকাশে যে বায়োলজিক্যাল ইন্সটিংট বা জিনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ইন্সটিংট বা পরিবেশ যে সমানভাবে গুরুত্বপূণর্ এটি আবিষ্কার করেন হেলেন ফিশার। তিনি গবেষণা করে দেখান আমাদের প্রেমের প্রধানত তিনটি স্তর রয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে লাস্ট বা কামুকতা। এ স্তরটি হচ্ছে প্রেমের প্রাথমিক স্তর। কোনো নারীকে দেখলে একজন পুরুষের স্বাভাবিক যে আগ্রহ বা কোনো পুরুষকে দেখলে একজন নারীর যে স্বাভাবিক আগ্রহ, তা হচ্ছে লাস্ট। এ স্তরটি কিশোর-কিশোরীদের মাঝে বেশি তীব্রভাবে কাজ করে। কারণ এ স্তররটি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যে হরমোনগুলো জড়িত, তা কিশোর-কিশোরীদের মাঝে বেশি মাত্রায় থাকে। লাস্ট হচ্ছে হরমোনের প্রভাবে নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি জেনারেল যে আগ্রহ বা কামুকতা। এর পরের স্তরটি হচ্ছে অ্যাটাকর্শন বা আকষর্ণ। এ স্তরে সুনিদির্ষ্ট একজন নারীর প্রতি কোনো পুরুষ আকৃষ্ট হয় বা সুনিদির্ষ্ট কোনো পুরুষের প্রতি কোনো নারী আকৃষ্ট হয়। এ স্তরে যে হরমোনগুলো কাজ করে, দেখা যায় সেগুলোর প্রভাবে প্রেমিককে বা প্রেমিকাকে না দেখলে অস্থির লাগে, আবার তাকে দেখলে হাটির্বট বেড়ে যায়, ঘামতে থাকে, খুব ভালো লাগে ইত্যাদি ঘটনা ঘটে। আর প্রেমের সবের্শষ স্তরটি হচ্ছে অ্যাটাচমেন্ট বা আসক্তি। এ পযাের্য় এসে প্রেমিক-প্রেমিকা একসঙ্গে থাকার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। পরিবার গঠন করে একসঙ্গে থাকতে চায়। সব প্রেম এই পযার্য় পযর্ন্ত আসে না। হেলেন ফিশার বলেন, মানুষের সম্পকর্গুলো প্রেমের স্তর এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিন্যাস দিয়ে পযের্বক্ষণ করলে বুঝতে সুবিধা হয়। হেলেন ফিশার তার এ অজর্নগুলো নিয়ে বেশ কিছু বেস্ট সেলার বই রচনা করেছেন। ন্যাচার, সায়েন্সসহ বিখ্যাত আন্তজাির্তক সায়েন্স ম্যাগাজিনে তার প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে।