ফনোগ্রাফ :কলের গান

প্রকাশ | ২১ মে ২০২২, ০০:০০

বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক
ফনোগ্রাফকে পরবর্তী সময়ে গ্রামোফোনও বলা হতো। ১৯৪০-এর দশকে এটি রেকর্ড পেস্নয়ার নামে পরিচিত ছিল- যা যান্ত্রিক রেকর্ডিং এবং শব্দ উৎপাদনের জন্য একটি যন্ত্র। যাকে বাংলা ভাষায় কলের গানও বলা হয়। শব্দ কম্পন তরঙ্গাকৃতি রেকর্ড করা হয় একটি সর্পিল আকৃতির খাঁজ, খোদাই করে অঙ্কিত একটি ঘূর্ণায়মান সিলিন্ডার বা ডিস্কের পৃষ্ঠ, যাকে রেকর্ড বলা হয়। এটি মূলত একটি রেকর্ডকৃত গান শোনার যন্ত্র। শব্দকে বিশেষভাবে নির্মিত কঠিন মাধ্যমে ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো নির্বাচিত চলমান মাধ্যমের ওপর দাগ কেটে বা খোদিত করে শব্দের কম্পাঙ্ককে কোনো রেখা অনুসরণ করে ধারণ করা হয়। পরে ওই চলমান গতি অনুসারে, ওই শব্দ ধারণকৃত মাধ্যমটিকে ফনোগ্রাফে বাজানো হয়। শব্দ ধারণের মাধ্যমটি চোঙ্গাকৃত বা চাকতির মতো হয়ে থাকে। এই মাধ্যমটি ফনোগ্রাফের নিজস্ব যন্ত্রের সাহায্যে ঘুরানো হয় এবং এর উপরে শব্দরেখার উপর সুচালো একটি শলাকার অগ্রভাগ ছুঁয়ে যাওয়ার সময়, শব্দরেখার কম্পাঙ্ককে শনাক্ত করে, শব্দ উৎপন্ন করে। পরে শব্দ বর্ধক যন্ত্রের সাহায্যে তা জোরালো হয়ে ওঠে। ফনোগ্রাফের ইতিহাস : এডিসনই এমন একটি ডিভাইস আবিষ্কার করেছিলেন- যা শব্দ রেকর্ড এবং পুনরুৎপাদন উভয়ই করতে পারে। শব্দকে যথাযথভাবে যন্ত্রের সাহায্যে বারবার বাজানোর উপযোগী প্রথম যন্ত্র হলো টিউনিং ফর্ক। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই যন্ত্রটি প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন ইংরেজ বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং। কিন্তু যন্ত্রের কাঁটাকে এমনভাবে তৈরি করা হতো যাতে আঘাত করলে সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি হয়। এতে কোনো শব্দকে গ্রহণ করে ধারণ করা যায় না। এখনো পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বক্তৃতা, সংগীত এবং অন্যান্য শব্দগুলোর জন্য বায়ুবাহিত রেকর্ডিংয়ের জন্য প্রথম পরিচিত ডিভাইস ফোনোটোগ্রাফ, তৈরি করেন ফরাসি উদ্ভাবক এডওয়ার্ড-লিওন স্কট ডি মার্টিনভিল। এই যন্ত্রটির স্বত্বাধিকার গ্রহণ করা হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ। এই যন্ত্রটিও তৈরি করা হয়েছিল শব্দ-গবেষণাগারের জন্য। বাতাসের ভেতর দিয়ে ভেসে আসা শব্দ এই যন্ত্রের পার্চমেন্ট কাগজের পর্দায় আঘাত হানতো। এর ফলে যে শব্দের কম্পাঙ্ক সৃষ্টি হতো তা এই পর্দার সঙ্গে যুক্ত একটি বিশেষ ধরনের লেখনীকে কম্পিত করত। এই লেখনী একটি ঘূর্ণায়মান চোখের উপর রাখা এক ধরনের কালচে কাগজের উপর শব্দ কম্পাঙ্কের ছবি আঁকতো। মূলত শব্দের প্রকৃতি চাক্ষুষভাবে পরীক্ষা করার জন্য এই যন্ত্র ব্যবহৃত হতো। কাগজে আঁকা এই শব্দ-কম্পাঙ্ক বাজানোর কোনো ব্যবস্থা সে সময়ে ছিল না। প্রাথমিক ফোনোগ্রাফ: টমাস আলভা এডিসন শব্দ ধারণ এবং তা পুনরায় বাজানোর পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সমন্বয় করার কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের মে এবং জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এই আবিষ্কারের বিষয়টি প্রকাশ করেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১ নভেম্বরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ফেব্রম্নয়ারিতে তিনি এই আবিষ্কারের স্বত্বাধিকার লাভ করেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে এই গ্রামোফোন বিক্রয় করা হয়েছিল। এডিসনের আদি ফনোগ্রাফে শব্দ ধারণ করা হতো পাতলা টিনের পাতের উপর। এই পাতটি বসানো হতো একটি চোঙার উপরে। এই চোঙাটিকে একটি হাতলের দ্বারা সুসম গতিতে ঘুরানো হতো। শব্দ ধারণ হতো এই টিনের পাতের উপর আঁচড় কেটে। এই পদ্ধতিতে শব্দ ধারণ করা হয়েছিল ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর এডিসন তার যন্ত্রটিকে ক্রমে ক্রমে আরও উন্নত করেন। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এমিল বারলিনার সিলিন্ডারের পরিবর্তে সমতল ও গোলাকার ডিস্ক ব্যবহার করেন। তিনি ডিস্কে স্পাইরাল ট্রাকের প্রবর্তন করেন। একটি মাস্টার ডিস্ক থেকে একাধিক কপি করার পদ্ধতিও তিনি প্রবর্তন করেন। এই যন্ত্রটি গ্রামোফোন নামে পরিচিতি লাভ করে। গ্রামোফোন এবং এইচএমভি : এই যন্ত্রটি ছিল মূলত এডিসনের ফনোগ্রাফ যন্ত্রের উন্নত সংস্করণ। পরে এই যন্ত্রের বিপণনের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল ভোল্টা গ্রামোফোন কোম্পানি। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই যন্ত্রটি সর্ব সাধারণের সামনে হাজির করা হয়েছিল। ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এমাইল বার্লিনার নতুন ধরনের একটি যন্ত্র হাজির করছিলেন। যার নাম দেন গ্রামোফোন। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, মোম এবং বেনজিনের প্রলেপ দেওয়া এক ধরনের দস্তার চাকতির উপরের সর্পিলাকারে শব্দরেখা অঙ্কিত হতো। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ড বাজারজাত করা শুরু হয়। তখন এই রেকর্ডের ব্যাস ছিল ৫ ইঞ্চি (১৩ সেন্টিমিটার)। এই রেকর্ড একটি থালার উপরে রেখে হাতল ঘুরিয়ে চালাতে হতো। মূলত এই রেকর্ডগুলো শব্দ তৈরির খেলনা সামগ্রীর মতো। পরে এই যন্ত্রটির শব্দধারণ প্রক্রিয়াটিকে আরও কম ব্যয়বহুল করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ ছাপ দেওয়া প্রক্রিয়ায়, একই রেকর্ডের অনেক কপি তৈরি করা যেত। কিন্তু সিলিন্ডার পদ্ধতির রেকর্ডে তা সম্ভব ছিল না। কিন্তু শব্দের মানের বিচারে এডিসনের সিলিন্ডার পদ্ধতিতে ধারণকৃত শব্দের মান অনেক ভালো ছিল। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের একটি গ্রামোফোন ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিনার রেকর্ড কোম্পানি তাদের ট্রেডমার্কসহ রেকর্ড বাজারজাত করা শুরু করে। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এই যন্ত্রটি একটি চমৎকার অবয়ব লাভ করেছিল। এর ভেতরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোল্টা গবেষণাগারে ঈযধৎষবং ঝঁসহবৎ ঞধরহঃবৎ এবং ঈযরপযবংঃবৎ ইবষষ- এর তত্ত্বাবধানে আরও একটি যন্ত্র হয়েছিল। এই বিজ্ঞানীদ্বয় এর নাম দিয়েছিল গ্রামোফোন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানি ভেঙে যায়। পরে এই কোম্পানি নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই কোম্পানির নাম ছিল ঠরপঃড়ৎ ঞধষশরহম গধপযরহব ঈড়সঢ়ধহু। কম্পিউটার সিডি আবিষ্কারের পর থেকে গ্রামোফোনের চাহিদায় মারাত্মক বিপর্যয় ঘটে। বর্তমানে রেকর্ড এবং গ্রামোফোন যন্ত্র একটি শো-পিসে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিটি ফনোগ্রাফে কয়েকটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ থাকে। অংশগুলো হলো? ১. ডিস্ক ঘূর্ণন উপযোগী যন্ত্র থাকে। এই অংশটির গতি নিয়ন্ত্রক চাবি থাকে। এই চাবির সাহায্যে টার্নটেবলের আরপিএম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ২. রেকর্ডের ট্র্যাকের ওপর দিয়ে পিন সঞ্চালনের উপযোগী পিন সংবলিত হ্যান্ডেল থাকে। ৩. রেকর্ডের ম্যাকানিক্যাল শব্দকে বৈদু্যতিক সংকেতে পরিণত করার উপযোগী যন্ত্র থাকে। ৪. বৈদু্যতিক শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য অ্যামপিস্নফায়ার থাকে। ৫. শব্দের চূড়ান্ত মান পাওয়ার জন্য স্পিকার থাকে।