সামাজিক অবক্ষয়ে ভ‚মিকা রাখছে স্মাটের্ফান

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আলীজা ইভা
বাংলাদেশ ও ভারতে যেভাবে ধষের্ণর ভিডিও ভাইরাল হওয়ার উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটছে তাতে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, স্মাটর্-ফোন এবং সহিংসতায় পরিপূণর্ পণর্ ভিডিও, যৌনতা সম্পকের্ শিক্ষার অভাব যৌন সহিংসতার ঘটনা বাড়িয়ে দিতে পারে। গবেষণায় উঠে এসেছে এই ধরনের তথ্য। বাংলাদেশের বেশকয়েকজন সমাজকমর্ গবেষক এবং সমাজবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলে জানা যায়, পনোর্গ্রাফীর মাধ্যমে ধষের্নর এক ধরনের অঘোষিত ট্রেনিং হচ্ছে বাংলাদেশে। সমাজে বঞ্চিত শ্রেণী এই ট্রেনিংকে বাস্তবায়নে যেন ভূমিকা রাখছে। সাম্প্রতিক গণধষের্নর রিপোটর্গুলো এবং শিশু ধষের্ণর রিপোটর্গুলো বিশ্লেষণ করলে এর সত্যতা বোঝা যায়। উপমহাদেশের বড় দেশ ভারতেও এ্কই ধরনের চিত্র রয়েছে। একদল টিনএজার একজন তরুণীর শরীর থেকে কাপড় টেনে খোলার চেষ্টা করছে-এমন একটি ভিডিও চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতের জনপ্রিয় একটি সামাজিক মাধ্যম হোয়াটস অ্যাপে ভাইরাল হয়। সেখানে দেখা যায় মেয়েটি ছেলেদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অনুনয় করতে থাকে, তাদের ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে কিন্তু তারা ব্যঙ্গ করতে করতে, হাসতে হাসতে প্রচÐ উপভোগের সাথে অপকমির্ট করতে থাকে। সেই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশ এটা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় যে বিহারের একটি গ্রামে ওই ঘটনা ঘটানো হয়েছিল এবং অভিযুক্ত তরুণদের আটক করা হয়েছিল। প্রদেশটির রাজধানী থেকে কাছেই সেই গ্রামটির নাম জেহানাবাদ। সেখানকার বাসিন্দাদের মাঝে বিষয়টি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে এবং তারা পুরো ঘটনার জন্য দোষারোপ করছে স্মাটের্ফানকে। ভারতে পনোর্গ্রাফি বিষয়ক কোনোকিছু তৈরি এবং শেয়ার করা অবৈধ কাজ। যদিও সস্তা ইন্টারনেট ডাটা এবং স্মাটর্-ফোনের কারণে সেসব সহজেই মিলে যাচ্ছে হাতের নাগালে, কিন্তু উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, নারী-পুরুষের সম্পকর্ এবং যৌনতার বিষয়ে সেসব তাদের অথর্পূণর্ কোনো ধারণাই দিতে পারছে না। স্থানীয় অনেক কিশোর-তরুণ বিবিসির সংবাদদাতার কাছে স্বীকার করেছেন যে, তারা যৌন হয়রানি এবং ধষের্ণর ভিডিও দেখেছেন। ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর জানায়, সে এরকম ২৫টির বেশি ভিডিও দেখেছে, সে এটাও জানায় যে নিজেদের বন্ধুদের মধ্যে তারা স্মাটর্-ফোনে এসব আদান-প্রদান করে থাকে। তার ভাষায়, ‘আমার ক্লাসের অধিকাংশ ছেলেই একসাথে বসে কিংবা তারা নিজেরা নিজেরা এসব ভিডিও দেখে।’ আরেক কিশোর বলে, ‘এটা দারুণ লাগে কারণ সবাই এটা করে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ভারতীয় বহু পুরুষের ক্ষেত্রেই এভাবে যৌনতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। চলচ্চিত্র পরিচালক এবং লেখক পারমিতা ভোহরা এজেন্টস অব ইশক (ভালবাসার এজেন্ট) নাম দিয়ে একটি ওয়েবসাইট পরিচালনা করছেন যেখানে ‘সেক্স’ বিষয়ে খোলামেলা কথা-বাতার্ হয়ে থাকে। তিনি বলেন, ‘আমাদের বেড়ে ওঠার সময় যৌন শিক্ষা দেয়া হয়নি কিংবা এসব বিষয়ে স্বাভাবিক প্রাপ্তবয়স্ক আলাপও হয়নি।’ ভারতে স্মাটর্-ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা চারশ মিলিয়ন এবং তাদের অধেের্করও বেশি লোক হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে। এই ধরনের ভিডিও শেয়ার করতে এই মাধ্যমটিই প্রায়শ ব্যবহার করা হয়। বিবিসিকে দেয়া এক বিবৃতিতে হোয়াটসঅ্যাপ কতৃর্পক্ষ বলছে, ‘আমাদের প্লাটফমের্ এই ভয়াবহ ধষের্ণর ভিডিও এবং শিশু পনোর্গ্রাফির কোনো স্থান নেই। এ কারণে আমরা এসব বিষয়ের মতো সমস্যার ক্ষেত্রে রিপোটর্ করার বিষয়গুলো সহজ রেখেছি, যাতে আমরা ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্ট ব্যান (নিষিদ্ধ) করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি। আমরা ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যে কোনো আইনগত জিজ্ঞাসা বা অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাদের তদন্ত কাজে সহায়তা করে থাকি।’ উত্তরাঞ্চলীয় উত্তরাখÐ প্রদেশে কয়েকজন যুবক তাদের মোবাইল ফোনে পনর্্য ভিডিও দেখে এক স্কুলছাত্রীকে ধষের্ণর ঘটনার পর তা ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্ট করেছিল। সেটিকে কেন্দ্র করে, উগ্র পনোর্গ্রাফি রয়েছে এমন ওয়েবসাইটের ওপর ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোটের্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পুনবর্হাল করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নিদের্শনা দেয় স্থানীয় একটি আদালত। ব্যাপক বিক্ষোভের পর প্রায় তৎক্ষণাৎ সেটি বাতিল করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা কেবলমাত্র সহিংসতা কিংবা আপত্তিকর ভিডিও রয়েছে এমন ৮০০-র মতো ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যদিও এর খুব একটা প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলা যাবে না। বড় বড় পনোর্গ্রাফি সাইটগুলোর অন্যতম একটি সাইটকে বøক করে দেয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সেটি আবার নতুন ইউআরএলসহ হুবহু একইরকম আরেকটি সাইট (মিরর সাইট) তৈরি করে ফেলেছে এটির ভারতীয় বাজারকে লক্ষ্য করে। কিন্তু ‘ব্যান’ বা নিষিদ্ধ করাই কি সমাধান? অনেকের বিশ্বাস প্রজনন শিক্ষার ঘাটতি এই ধরনের সহিংস এবং নারী-বিদ্বেষী ভিডিওর প্রতি আকষর্ণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই নারী কিংবা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই যৌন সম্পকর্ এবং অভিজ্ঞতা কি সে সম্পকের্ গভীর কোনো ধারণা থাকে না। সরকার অবশ্য এই অবস্থা বদলানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০০৯ সালে অ্যাডলসেন্ট এডুকেশন প্রোগ্রাম চালুর মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য ছিল- কিশোর বয়সের নানা পরিবতর্ন এবং লিঙ্গ, যৌনতা, যৌন সংক্রামিত রোগ ও মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার সম্পকির্ত ভ্রান্ত ধারণা দূর করা। কিন্তু এই কমর্সূচির বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে এখনো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জেহানাবাদেরই একটি গালর্স স্কুলের অধ্যক্ষ জানালেন এই কমর্সূচি সম্পকের্ তার কোনো ধারণাই নেই। ভারতের প্রজ্বলা সংস্থাটি দীঘির্দন ধরে যৌন সহিংসতা এবং পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় হায়দ্রাবাদ শহরের এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সুনীতা কৃষ্ণাণ বলছেন, এই ধরনের হিংসাত্মক ভিডিওগুলো ভারতের সমাজে প্রচলিত প্রাচীন বিশ্বাসকে আবারও সামনে তুলে ধরছে যে, একজন নারীর পছন্দ-অপছন্দ গুরুত্বহীন এবং তার কোনো কতৃর্ত্ব নেই। মিজ কৃষ্ণাণ যিনি নিজে ধষের্ণর শিকার হয়েছিলেন, তিনিও এ ধরনের ভিডিও পেয়েছেন এবং সেসব ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে ২০১৫ সালে পনর্্য সাইটগুলোর ওপর সুপ্রিম কোটের্র নিষেধাজ্ঞা এসেছিল তার অক্লান্ত চেষ্টার ফলাফল হিসেবে। যদিও এসব ভিডিওর অল্প সংখ্যক সরিয়ে ফেলতে তিনি সক্ষম হয়েছেন কিন্তু তিনি বলছেন, ইন্টারনেট থেকে কোনোকিছু সম্পূণর্ভাবে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। বিহারের ৪০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র তিনজন। তাদেরই একজন রঞ্জিত রঞ্জন মনে করেন এইসব ভিডিও সম্পকের্ নিরুদ্বেগ মনোভাব বিপজ্জনক। ‘কেউই আসলে গুরুত্ব দিচ্ছে না। লোকজনের যদি এই মেয়েদের সম্পকের্ সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ থাকতো, তাহলে তারা এই ধরনের ভিডিও শেয়ার না করে বরং পুলিশের কাছে গিয়ে জানাতো।’ মিজ রঞ্জন আরও উদ্বিগ্ন কারণ তার মতে এ ধরনের ভিডিও বানানোর জন্য যেন রীতিমতো ‘একধরনের প্রতিযোগিতা’ নজরে আসছে তার। ‘যদি এগুলো এভাবে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনা চলতে থাকে এবং আমাদের কোনো ধরনের যৌন-শিক্ষা না থাকে, তাহলে নারীদের কেবল বস্তু হিসেবে এবং বিনোদনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করতে হবেÑ এমন ধারণাই বদ্ধমূল করতে উৎসাহিত করবে।’