রোবোটিক্স সভ্যতার উৎকর্ষতায় মানুষ

মানুষের তৈরি করা শিল্প আজ মানুষেরই মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। কারণ রোবোটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নির্ভুল এবং দ্রম্নততা। কাজের ক্ষেত্রে তাই মানুষের চেয়ে রোবোটের চাহিদাই বেশি। উন্নত দেশে তাই এখন যন্ত্রের জয়জয়কার। কাজের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে রোবটের ব্যবহার করা হচ্ছে না। চিকিৎসায়, পরিবহণে, উৎপাদন কার্যে, যোগাযোগে, গৃহকর্মে মোট কথা সব কাজেই সেসব দেশে চলছে রোবোটের ব্যবহার।

প্রকাশ | ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

অলোক আচার্য
বর্তমান সভ্যতাকে রোবোটিক সভ্যতা বলা হয়। সভ্যতার উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে এই যান্ত্রিক সভ্যতা ক্রমেই উন্নততর হচ্ছে। মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে মানুষের তৈরি যন্ত্র। কাজের সুবিধার্থে, দ্রম্নততায়, কাজের নির্ভুল বাস্তবায়নে, ক্লান্তিহীন কাজে মানুষ আজ মানুষের থেকে যন্ত্রের ওপর বেশি আস্থা রাখছে। মানুষের তৈরি করা রোবট আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে কাজ করছে। রোবট নামটি শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অবিকল মানুষের মতোই এক ধরনের যন্ত্র যা মানুষের সঙ্গে, মানুষের আদেশে নির্ভুলভাবে কাজ করছে। তবে রোবট কেবল মানুষের আকৃতিতে নয় বরং অন্যান্য প্রাণীর আকৃতিতেও তৈরি হচ্ছে। অটোমেশন ও অ্যাপিস্নকেশনের অভূতপূর্ব উন্নতির কারণে রোবট এখন নতুন প্রজন্মের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে গভীরভাবে একীভূত হয়েছে। এটি অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে জায়গা করে নিয়েছে। আগামী সভ্যতার নির্ভরতা হচ্ছে যাচ্ছে রোবট নির্ভর। উন্নত দেশগুলো ইতোমধ্যেই সেই দিকে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। রোবোটিকস শিল্প থেকে গত বছর চীন প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। চীনের শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশটিতে ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শিল্পে ব্যবহৃত রোবটের উৎপাদন ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির শিল্প মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই চীনে তৈরি হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট রোবট। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৫ লাখ ৩০ হাজার সার্ভিস ইউনিট রোবট তৈরি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৯ দশমিক ৬ ভাগ বেশি। বৈদু্যতিক গাড়ি, লিথিয়াম ব্যাটারি ছাড়াও অন্যান্য উদীয়মান শিল্পে রোবটের ব্যবহার খুব দ্রম্নত বাড়ছে। রোবোটিকস শিল্প এখন একটি বৈপস্নবিক দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আন্তর্জাতিক রোবটিক্স ফেডারেশনের ২০২০ সালের তথ্যমতে, চীনে প্রতি ১০ হাজার শ্রমিকের বিপরীতে রোবট ব্যবহার হচ্ছে ২৪৬টি। যুক্তরাষ্ট্রে এই হার ২৫৫টি। শিল্পক্ষেত্রে রোবট ব্যবহারে শীর্ষে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার শ্রমিকের বিপরীতে রোবট ব্যবহার হচ্ছে ৯৩২টি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছে, চীনের সামগ্রিক রোবোটিক্স ক্ষমতা ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বসেরাদের কাতারে থাকবে। ছোটবেলায় রোবট নিয়ে টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখার কথা সবার মনে আছে। পুলিশ অফিসার সেই রোবট নানা অসাধ্য সাধন করত। তখন থেকেই রোবট নিয়ে মনের ভেতর এক ধরনের উত্তেজনা কাজ করত। রোবট নিয়ে বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করেছেন। এখনো রোবট নিয়ে বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। নিত্যনতুন মডেল আর আরও কার্যকর করতে রোবটের এই গবেষণা। আজ রোবট মানুষের পরিবর্তে মানুষের স্থানে কাজ করে যাচ্ছে। কাজের অনেক ক্ষেত্র আজ রোবটের দখলে। অনেকজনের কাজ একটি রোবট দিয়ে করানো সম্ভব হচ্ছে। ফলে রোবটের চাহিদাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে রোবট শিল্প উন্নতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কাজের ক্ষেত্র সিমাবদ্ধ হচ্ছে কিনা? দ্বিতীয়ত, যেহেতু বিজ্ঞানকে থামিয়ে রাখার উপায় নেই; তাই এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে আমরা কতটুকু প্রস্তুত রয়েছি। এ নিয়ে অবশ্য বহু মতামত রয়েছে। কেউ বলছেন এর বিকাশ সাধন মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হয়ে নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে। আবার কেউ বলছেন, এতে সাময়িক সংকট তৈরি হতে পারে। এর স্বপক্ষে কিছু কারণও রয়েছে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্সিং অটোমেশন বা 'এ৩'-র তথ্যানুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ এবং কানাডা ও মেক্সিকোর কয়েকটি অংশে বিভিন্ন কোম্পানি ৪৪ হাজারের বেশি রোবট অর্ডার করেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি ও নতুন রেকর্ড। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এসব মেশিনের সর্বমোট মূল্য গিয়ে ঠেকেছে ২৩৮ কোটি ডলারে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে কোম্পানিটির মানবকর্মীর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে রোবট। চীনের ইন্ডাস্ট্রি ও টেকনোলজি নিয়ে বিশ্লেষণ করা নেদারল্যান্ডসভিত্তিক প্রাইভেট রিসার্চ কোম্পানি ডাটেনার তথ্যমতে, চীনা সরকার দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০১১ সালে ৩ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার এআইয়ে ও ৮ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার মেশিন লার্নিংয়ের গবেষণায় খরচ করেছে। ২০১৯ সালে আবার দেশটির এআই খাতে গবেষণা খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৮৬ মিলিয়নে; আর মেশিন লার্নিং গবেষণায় খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫ মিলিয়নে মানুষের তৈরি করা শিল্প আজ মানুষেরই মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। কারণ রোবোটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নির্ভুল এবং দ্রম্নততা। কাজের ক্ষেত্রে তাই মানুষের চেয়ে রোবোটের চাহিদাই বেশি। উন্নত দেশে তাই এখন যন্ত্রের জয়জয়কার। কাজের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে রোবটের ব্যবহার করা হচ্ছে না। চিকিৎসায়, পরিবহণে, উৎপাদন কার্যে, যোগাযোগে, গৃহকর্মে মোট কথা সব কাজেই সেসব দেশে চলছে রোবোটের ব্যবহার। তবে যাই ঘটুক না কেন আমরা কোনোভাবেই বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে বিলম্বিত করতে পারব না। বরং সাদরে গ্রহণ করাটাই যুক্তিযুক্ত। বিজ্ঞানের আশীর্বাদটুকু কাজে লাগানোই আমাদের দায়িত্ব। ফলে প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। কল্প কাহিনির রোবোট নিয়ে রচিত হয়েছে বহু সিনেমা, গল্প, নাটক। সেসব কল্পগল্পে রোবোটের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ হয়েছে। টিকে থাকার লড়াইয়ের কাহিনি আছে। আমাদের দেশও কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় একেবারে পিছিয়ে নেই। আমাদের দেশের বহু মেধাবী ছেলেমেয়েরা নানা রকম রোবোট তৈরি করছে। এসব রোবোট আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রদর্শিত হচ্ছে। আমরা সেসব পত্রপত্রিকায় দেখছি। দেখছি এবং উৎসাহিত হচ্ছি। এর অর্থ হলো যে, আমাদের দেশ এই প্রতিযোগিতায় রয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এটি নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। তার চেয়ে বরং আমরাও পুরো দমে এই প্রতিযোগিতায় নাম লেখাই। সারা বিশ্বে এই আবেগ অনুভূতিহীন এই যন্ত্র নিয়ে মানুষ নানা রকম কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে। রোবোটের প্রতি ভালোবাসাও জন্মাচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত হলো গার্মেন্টস শিল্প। যেখানে সংস্থান হচ্ছে দেশের গ্রামাঞ্চল থেকে উঠে আসা অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার নারী-পুরুষ। এর মধ্যে নারীদের কথাই বেশি উলেস্নখযোগ্য। মোট কথা নারী কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় সেক্টর হলো গার্মেন্টস শিল্প। বেকার সমস্যা সমাধানে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কিন্তু এমন দৃশ্যও হতে পারে যখন এসবের কাজের একটি বড় অংশই যাবে রোবটের দখলে। মানুষের বদলে সেসব স্থানে কাজ করবে রোবট। অতি অল্প সংখ্যক রোবোট দিয়েই তখন প্রচুর কাজ করা সম্ভব হবে। তবে সেদিন আমাদের দেশে কত দূরে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। উন্নত দেশে এরই মধ্যে শিল্প কলকারখানায় রোবটেরা নিখুঁতভাবে কাজ করে চলেছে। ফলে আমাদেরও পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় মানুষের চেয়ে রোবোট অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। ফলে একসময় না একসময় যান্ত্রিক প্রক্রিয়াই হবে উৎপাদন নির্ভর প্রতিষ্ঠানের একমাত্র পছন্দ। আর যদি তাই হয় তখন চাকরির বাজারে তার প্রভাব পড়বে। বহু শ্রমিক বেকার হবেন। প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন জনশক্তি এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে টিকে থাকতে সক্ষম হলে যারা পুরোপুরি শ্রম নির্ভর তারা কর্মহীন হয়ে পড়বে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া এ সম্ভাবনাকে আরও ত্বরান্বিত করবে। প্রথম প্রথম এই রোবট প্রযুক্তি ব্যয়বহুল হলেও ধীরে ধীরে এ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবেই। কারণ প্রথম প্রথম খরচ বৃদ্ধি পেলেও দীর্ঘমেয়াদে যখন তা ব্যবহার করা হবে তখন উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে। কারণ কর্মী নির্ভর উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে রোবট নির্ভর হওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট বহু খরচ কমে আসবে। এ সুবিধাটাই সবাই নেবে। কেবল প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এ অবস্থা যখন অধিকাংশ জায়গা দখল করে নেবে তখন আমরা তা কিভাবে মোকাবিলা করব সেই প্রস্তুতি। আমি অনুমান করতে পারি, প্রযুক্তিই আমাদের সেই রাস্তা দেখিয়ে দেবে। আমাদের দেশ প্রযুক্তিতে যেভাবে এগিয়ে চলেছে, এভাবে এগিয়ে চললে দেশের বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়েই বড় হয়ে উঠবে। ফলে ততদিনে আমরা প্রস্তুত হয়েই যাব। এটা আমার অনুমান। বাস্তবতার সঙ্গে এগিয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হবো তাহলো বেকার জনগোষ্ঠী এবং প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন জনগোষ্ঠী। কিন্তু যে ধরনের নারী-পুরুষ পোশাক শিল্পে কর্মরত রয়েছে তাদের দিয়ে সমস্যার মোকাবিলাটাই চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বিষয়টা এমন যে মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য যে যন্ত্র তৈরি করা হয়েছিল সেই যন্ত্রটিই এখন স্বয়ং মানুষেরই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আগেই বলেছি যে, রোবট নিয়ে সমস্যার ভিন্নমত রয়েছে। ভিন্ন মতের কারণ হলো প্রযুক্তির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। আর এর সমাধানটি করছে প্রযুক্তিই। আমরা তো বহু দূর এগিয়েছি। মহাকাশে আমাদের স্যাটেলাইট রয়েছে। এক তথ্যে বলা হচ্ছে, চতুর্থ শিল্প বিপস্নব হলে চাকরি হারাবে ৫৫ লাখ মানুষ। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে গতানুগতিক কাজগুলো করবে মেশিন বা রোবট। বাংলাদেশেও এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া। শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প সবক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তিই আমাদের উন্নয়নের ঠিকানা দেখাবে। রোবট শিল্পও এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের একটি আশীর্বাদ। রোবটের সহায়তায় মানুষ আজ নানা বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিচ্ছে। বিজ্ঞানের ব্যবহার সর্বদাই মানব জাতির জন্য মঙ্গলজনক। ফলে রোবট নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলেই মনে হয়। যে সমস্যা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে তার সমাধানও আমাদের হাতেই রয়েছে।