পরিচালক রোজিনার গল্প

রোজিনা নামটি শুনলেই মনে ভেসে ওঠে ঢাকাই সিনেমার সোনালি সময়ের আলোচিত এক নায়িকার মুখ। যিনি তিন শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করে এ দেশের আপামর দর্শকের মনে স্থায়ী আসন গেড়েছেন। শুধু কী তাই! দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য গঠিত জুরি বোর্ডের সদস্যও ছিলেন তিনি। তবে আজ অভিনয়ের গল্প নয়, অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনাতেও তার হাত রয়েছে। নির্মাতা রোজিনাকে নিয়েই তারার মেলার আজকের প্রধান আয়োজন। লিখেছেন মাসুদুর রহমান

প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
যখন যেখানে... চলচ্চিত্রে অনিয়মিত হওয়ার পর থেকেই বেশিরভাগ সময় লন্ডনে থাকেন রোজিনা। তবে শেকড়ের টানে মাঝে মধ্যেই তিনি দেশে আসেন। করোনার প্রতিকুল পরিবেশে সরাসরি কথা না বলে মুঠোফোনেই কথা হলো তার সঙ্গে মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। আলাপচারিতার শুরুর দিকে ওপাশ থেকে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিলেন রোজিনার পালিত আদরের দুই কুকুর। ওদের সামলিয়ে অবশেষে আয়েশ করে বসেন কথার ঝুড়ি নিয়ে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ভালো আছেন বলে আলস্নাহর শুকরিয়া আদায় করে বলতে শুরু করেন রোজিনা। বলেন, 'করোনা নিয়েই আমাদের ভালো থাকার চেষ্টা চালাতে হবে। এখন এছাড়া কিছু করার নেই। কতদিন আর ঘরে বসে থাকা যায়। তবে সতর্ক হয়ে চলতে হবে আমাদের।' পেছনের শুরুর গল্প... রোজিনা সিনেমায় আসার পর বাংলাদেশের বাইরের চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন। নেপালি, পাকিস্তানি, ভারতীয়সহ প্রায় ৩০০ ছবিতে অভিনয় করা হয়েছে তার। অভিনয়ের বাইরে তিনি ১৫-২০টি নাটক-টেলিফিল্ম পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেন, 'অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাণ কাজও করা হয়েছে আমার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও শরৎচন্দ্রের সাহিত্য নিয়েই বেশি কাজ করেছি। প্রথম পরিচালনা করেছি শরৎচন্দ্রের 'ষোড়শী'তে। এটি চ্যানেল আইতে প্রচারিত হয়েছিল। এছাড়া 'মেজদিদি', 'বনের পাপিয়া' ইত্যাদি গঠনমূলক নাটক নির্মাণ করেছি। সাহিত্যের বাইরে... অনেকেই আছেন, যারা নির্দিষ্ট ছকের বাইরে কাজ করতে অভ্যস্ত নন। রোজিনা অভিনয়ের বাইরে যেমন নির্দেশনা দিয়েছেন তেমনই সাহিত্যের বাইরেও নির্দেশনা দিয়েছেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য, 'সাহিত্যের বাইরেও দু/একটি নাটক-টেলিফিল্ম করেছি। হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবালের গল্প নিয়েও কাজ করেছি। কবি কিংকর চৌধুরীর কাহিনি অবলম্বনে 'বদনাম' নামের একটি ধারাবাহিক নাটক ও চ্যানেল আইয়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক 'আলোর পথের যাত্রী' নির্মাণ করেছি। কাজগুলোর প্রচুর প্রশংসাও পেয়েছি। সর্বশেষ ৫/৬ বছর আগে 'আলোর পথের যাত্রী'তে নির্দেশনা দিয়েছি। সিনেমার কাজ শেষ না করে নাটক-টেলিফিল্মে নির্দেশনা দিব না। 'ফিরে দেখা' প্রসঙ্গ... চিত্রনায়িকা হিসেবে খ্যাতি পেলেও রোজিনার অভিনয় শুরু হয়েছিল মঞ্চ থেকে। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ছোটপর্দায় পরিচালনা করেও প্রশংসিত হয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতা এবার কাজে লাগাতে চান চলচ্চিত্রে। তার 'ফিরে দেখা' ছবিটি চলতি অর্থ বছরে অনুদান পেয়েছে। ছবিটির কাহিনিকার, পরিচালক ও প্রযোজকও তিনি। রোজিনা বলেন, 'অভিনয় করেই মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছি। এজন্য যতই দূরে থাকি না কেন, অভিনয় আমাকে খুব বেশি টানে। যেহেতু সিনেমাটির প্রযোজক ও পরিচালক আমি এবং গল্পও আমার নিজেরই তৈরি করা, তাই চেষ্টা করছি একটি সাবলীল পরিবেশের মধ্য দিয়েই এর কাজ সম্পন্ন করার।' গল্প ও প্রেক্ষাপট... মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। হবে আরও। নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে নির্মিত ছবিগুলো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রায় ছবিই আলোচনায় এসেছে। রোজিনার 'ফিরে দেখা' ছবির গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব ঘটনাকে ঘিরে। তিনি বলেন, '৭১ সালে তখন আমি ছোট থাকলেও আমার খুব ভালো মনে আছে যুদ্ধের সেইসব দিনগুলোর কথা। আমার দাদাবাড়ি রাজবাড়ী ও আমার নানার বাড়ি গোয়ালন্দে। আমি দেখেছি পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম আক্রমণ, রাজাকারদের নির্দয় দেশদ্রোহী কাজ। সেসব আমার হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। স্মৃতি থেকে এতটুকুও হারিয়ে যায়নি। সেই বাস্তব ঘটনাগুলো এক সময় সেলুলয়েডে বাঁধার পরিকল্পনা করি।' শুটিং ও শিল্পী নির্বাচন... ছবির চিত্রনাট্য ও শিল্পী নির্বাচন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই অনেক ছবি নির্মাণের ঘোষণা আসে। মহরতও হয়। কিন্তু এরপর মাঠে ছায়া পড়ে না অনেক ছবির। ঘোষণাতেই শেষ হয় অনেক সিনেমা বানানোর গল্প। রোজিনা তার ছবির শুটিং ও শিল্পী নির্বাচন নিয়ে বলেন, 'চিত্রনাট্য যতই নাড়াচাড়া করছি ততই পরিবর্তন ও সংশোধন হচ্ছে। ভালো করতে গিয়েই বারবার ঘষামাজা করছি। তবে এ বছর শুটিংয়ে যাচ্ছি না। করোনা পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হলে শুটিংয়ে যাব। শিল্পী নির্বাচন নিয়ে ভাবছি। আমিসহ মুখ্য চরিত্রে আরও ৪/৫ জন অভিনয় করবেন। কয়েক জনকে পরিকল্পনার তালিকায় রেখেছি। চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রকাশ করতে চাই না।' গান ছাড়া চলচ্চিত্র নির্বাক... ছবির গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে গান। গান ছাড়া চলচ্চিত্র যেন নির্বাক। গানের কারণেই অনেক ছবি জনপ্রিয় হয়েছে এমন নজিরও আছে আমাদের চলচ্চিত্রে। 'ফিরে দেখা' ছবির জন্য দুটি গান রাখছেন রোজিনা। তিনি বলেন, 'যেহেতু আমার এই ছবিটি বাণিজ্যিক ধারার ছবি নয়। তাই খুব বেশি গান রাখছি না। দুটি গান রাখার চিন্তা করেছি। দুটি গানই কবির বকুলের লেখা। ইতোমধ্যে একটি গান লেখা শেষ হয়েছে। কয়েকদিন আগেও গানের বিষয় নিয়ে বসেছিলাম।' সবশেষে চলচ্চিত্রের চলমান প্রসঙ্গ... বর্তমানে মৌলিক গল্পের দারুণ অভাব আমাদের চলচ্চিত্রে। নকল কিংবা কয়েকটি সিনেমার গল্পের সমন্বয়ে একটি গল্প থেকে তৈরি হচ্ছে এখনকার সিনেমা। এ নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনাও চলমান। এটাকে দর্শক হলবিমুখ হওয়ার অন্তরায় মনে করেন কেউ কেউ। এ নিয়ে রোজিনা বলেন, 'বর্তমান চলচ্চিত্রে মৌলিক গল্পের অভাব আছে ঠিক, তবে শুধু এ কারণেই যে দর্শক হলে আসছে না তা নয়। অন্যান্য কারণও জড়িত। আমাদের পর শাবনূর, মৌসুমীদের সময়টাও ভালো ছিল। এরপর কোথাকার মুনমুন, ময়ূরির মতো মেয়েরা এসে চলচ্চিত্রের পরিবেশটা নষ্ট করে দিয়েছে। এজন্য কিছু অসৎ প্রযোজক, পরিবেশক ও নির্মাতারাও দায়ী। অবশ্য এখন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তারপরেও আগের পরিবেশ ফিরে আসেনি। আগের মতো দর্শক হলে সপরিবারে সিনেমা দেখতে যেতে পারেন না। যতদিন না দর্শক পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা হলে যেতে পারবেন ততদিন হলে দর্শক শূন্যতা বিরাজ করবে বলে আমার মনে হয়। এছাড়া সিনেমা হলের সুন্দর পরিবেশ, ভালো গল্প, ভালো নির্মাণ, অভিনয়, প্রযুক্তির ব্যবহারেরও গুরুত্ব দিতে হবে।