শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চিরসবুজ রেখা

তারার মেলা ডেস্ক
  ০৮ অক্টোবর ২০২০, ০০:০০
রেখা

৬৫ বছর বয়সেও তাকে সবাই কিশোরী বলে ডাকেন। আয়েশ করে অনেকে তন্বী, তরুণী এমনকি আবেদনময়ী বলেও অভিহিত করেন। চিরসবুজ এ অভিনেত্রীর নাম রেখা। পুরো নাম ভানুরেখা গণেশন হলেও হিন্দি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রেখা নামেই বেশি পরিচিত। চলতি শতাব্দীতে এসেও রেখাকে বলিউডের চির সবুজ যৌন আবেদনময়ী অভিনেত্রী হিসেবে মনে করা হয়। আগামী ১০ অক্টোবর ৬৫ পেরিয়ে ৬৬- তে পা দিতে চলেছেন এ ভারতীয় অভিনেত্রী।

শুরুতে রেখার নামকরণ করা হয়েছিল ভানুরেখা। যার অর্থ সূর্যের আলো। সফল অভিনেত্রী, তারকাশিল্পী, আবেদনময়ী নৃত্যশিল্পী এমন নানা পরিচয়ে বলিউড ইতিহাসের পাতায় রেখা জলজলে হয়ে থাকবেন নিঃসন্দেহে। তবে জীবনের দুর্যোগ মোকাবিলা করে কঠিনকে গলিয়ে অনন্য হয়ে ওঠা যে ভানুরেখা, তিনি যুগে যুগে সাহস জোগাবেন অনেক কিশোরী, তরুণী, নারীকে।

১৯৬৬ সালে 'রাঙ্গুলা রত্নম' নামে একটি তেলেগু ছবির মাধ্যমে শিশুশিল্পী হিসেবে তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয়। কিন্তু নায়িকা হিসেবে ১৯৭০ সালে শাওন ভাদো নামে একটি ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বলিউডে যাত্রা শুরু করেন। যদিও প্রথম দিকে তার কিছু ছবি সাফল্য পায় কিন্তু সত্তর এর দশকের মাঝের দিকে রেখা অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। তিনি প্রায়ই তার সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং যখন তিনি পস্নাস্টিক সার্জারি সম্পন্ন করেন, তখন ভারতীয় মিডিয়া তাকে যৌন আবেদনের প্রতীক হিসেবে আখ্যায়িত করে।

জন্মের পর থেকে এতগুলো বসন্ত অবধি জীবনের ছুড়ে দেওয়া তিরগুলোকে সাহসের সঙ্গে প্রতিহত করে রেখা এগিয়ে চলেছেন নিজ সক্ষমতায়। চেন্নাই থেকে জীবনের সন্ধানে তখনকার বোম্বেতে ছুটে আসা এক কৃশকায় কিশোরী পুরুষশাসিত বলিউডে রাজত্ব করেছেন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে।

সাংবাদিক ইয়াসির উসমানের লেখা, 'দি আনটোল্ড স্টোরি' বইয়ে দেখা মিলেছে ভিন্ন এক রেখার। যে রেখা প্রকৃতই একজন যোদ্ধা, একজন ভানুরেখা।

জন্মই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল রেখার। শক্তিমান তামিল অভিনেতা জেমিনি গণেশন ও তেলেগু অভিনেত্রী পুষ্পাভ্যালীর ঘরে রেখার জন্ম ১৯৫৪ সালে। তবে রেখার মায়ের ছিল না বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি। সে কারণেই রেখার জন্মের পরে বাবার স্বীকৃতি মেলেনি। পিতার স্বীকৃতি ছিনিয়ে নিয়ে নিয়তি মুচকি হাসলেও রেখা সেই হাসিকেই ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন জন্মেও মাত্র ৪০ বছর পর। নিজের যোগ্যতায় কণ্টকাকীর্ণ বলিউডের শক্ত সিঁড়িগুলো চড়ে রেখা তখন সাফল্যের শীর্ষে। বলিউডের অস্কার ফিল্মফেয়ারের পুরস্কারের আসর বসে মাদ্রাজে ১৯৯৪ সালে। এই অনুষ্ঠানে জেমিনি গণেশনকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। বাবার হাতে আজীবন সম্মাননার পুরস্কার তুলে দেন তার স্বীকৃতি না পাওয়া কন্যা রেখা। জন্মের পর থেকে যে সন্তানকে স্বীকৃতি দেননি, ফিল্মফেয়ারের ভরা আসরে হাজারো লোকের মাঝে জেমিনি সেই কন্যা সম্পর্কে বলেন, 'আমি খুশি এই পুরস্কারটি বোম্বে থেকে আসা আমার প্রিয় সন্তানের কাছ থেকে নিতে পেরেছি।' হাজার লোকের ভরা আসরে বাবার দেওয়া এই স্বীকৃতি জয় করে নিয়তিকে জন্মক্ষণের সেই মুচকি হাসিটা ফিরিয়ে দেন বিজয়িনী রেখা।

জীবনের ছোটবড় চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আমরা যারা হতাশার সাগরে সাঁতরে বেড়াই, তাদের জন্য রেখার এই স্বীকৃতি আদায় এক অনন্য অনুপ্রেরণা। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশোরে, তখনো নিয়তির সুপ্রসন্নতার দেখা পাননি রেখা। সংসার আর মায়ের ঋণ মেটানোর প্রয়োজনে ১৪ বছর বয়সেই রঙিন চলচ্চিত্র জগতের অন্ধকার সিঁড়ি বাইতে শুরু করেন তিনি। নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে রেখা হয়ে ওঠেন তার ছয় সদস্যের পরিবারের আলো। রেখা তার পরিবারকে একাই এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া এই নারী নিজেই বলেছেন, 'বেশির ভাগ সময় আমি ছিলাম আমার ভাইবোনদের মা, এমনকি আমার মায়েরও মা।'

রঙিন পর্দায় লাস্যময়ী রেখার আবেদন, নাচ, অভিনয় আরও অনেক কিছুতে তিনি জুড়ে আছেন বড় জায়গা। তার ব্যক্তিগত জীবন কয়েক দশক ধরে হয়েছিল একটি দেশের জাতীয় ইসু্য। তবে সবকিছুর অন্তরালে পুষ্পাভ্যালির পরিবারকে কঠোর পরিশ্রম করে আগলে রাখা যে রেখা, সেই নারী অন্য আর সবার জন্য উদাহরণ। বুড়ো বয়সে ছেলে দায়িত্ব নেবে যারা ভাবেন, তাদের জন্যও উদাহরণ তিনি। এক নারীর একটি পরিবারের কর্তা হয়ে ওঠার এই গল্প সমাজের সেই সবার জন্যই অনুপ্রেরণা, যারা মেয়েদের এখনো পিছিয়ে রাখেন।

সফল রেখার খ্যাতি অনেক চোখে স্বপ্ন জাগায়। অনেক জীবনকে অনুপ্রাণিত করে। তবে সফলতার যে চূড়ায় রেখাকে দেখা যায়, সেই পথটা ততটাই কণ্টকাকীর্ণ ছিল। ১৪ বছরের কিশোরীর ক্যামেরার সামনে প্রথম দাঁড়ানো ছিল এক বিব্রতকর ঘটনা। প্রথমদিনের শুটিংয়ে রেখাকে কোনো কিছু না জানিয়ে পরিচালক আয়োজন করেন একটি 'চুমুর দৃশ্য'।

ক্যামেরার সামনে অতর্কিত সহ-অভিনেতার সে আচরণ, পুরো শুটিং সেটের সব কর্মীর উলস্নাসে চুপসে যায় কৃশকায় কিশোরী। তবে ক্যামেরার সামনে পুরুষশাসিত বলিউডের সেই আচমকা আচরণে হেরে গিয়ে হারিয়ে যাননি তিনি। সব প্রশ্নের সব জবাব মোকাবিলা করে এগিয়ে গেছেন সমান্তরালে। রেখার অভিনয় কখনো প্রশংসা কুড়িয়েছে, কখনো সমালোচনা। নিজেকে বারবার ভেঙে গড়েছেন তিনি। তার পেশার প্রয়োজনে হয়ে উঠেছেন ভিন্ন একজন। ক্যামেরার পেছনের জীবনের চড়াই উতরাই চলেছে সমান্তরালে। বারবার সম্পর্কে জড়িয়ে প্রতারিত হয়েছেন, ফিরে এসেছেন- তবে সংসার বাঁধা হয়নি। পরে যখন দিলিস্নর ব্যবসায়ী মুকেশের সঙ্গে ঘর বাঁধেন, সেখানেও ধাক্কা আসে কিছুদিন পরই। এরপর মুকেশের আত্মহত্যায় 'জাতীয় ডাইনি'তে পরিণত হন রেখা। বলিউডের শাহেনশাহ অমিতাভের সঙ্গে 'প্রশ্নবিদ্ধ' সম্পর্ক নিয়েও এখন পর্যন্ত জল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন তিনি। তবে জীবনের এ সব উত্থান-পতন সামলেই রেখা হয়ে উঠেছেন তিনি।

তাই কেবল অভিনয় পেশা বা রুপালি জগতে নয়, যে কোনো পেশায় বা যে কোনো জীবনে সাফল্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা যারা ভাবি, 'আমার সঙ্গেই এমন কেন হলো?' তাদের জন্যও রেখার গল্প শিক্ষণীয় হতে পারে। জীবন তার তালেই তার গন্তব্যের দিকে এগোবে। সেখান উত্থান থাকবে, পতন থাকবে, অবহেলা থাকবে, গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, অন্ধকার রাত থাকবে, আলোকিত দিন থাকবে। তবে জীবন যা নিয়েই হাজির হোক, আমি কীভাবে তা নিচ্ছি, সেটাই এগিয়ে যাওয়া।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<114534 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1