মমতাজ :নিভৃতচারী এক স্বপ্নবাজ

কল্প-কাহিনীকেও যেন হার মানায় তার গল্প। জন্মেছিলেন এক দরিদ্র বাউল পরিবারে। শৈশব-কৈশোর-যৌবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে চরম অভাব আর দৈন্যতায়। গানকে সঙ্গী করেই জীবনের সমস্ত ক্ষুধা নিবারণের জন্য যিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন এবং পর্যায়ক্রমে সাফল্য অর্জন করেছেন তারই এক জীবন্ত উদাহরণ মমতাজ। সাতশ'র বেশি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ, ১০ হাজার গান গেয়ে গিনেস বুকে নাম লেখানো, নিজের জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ, পরপর তিনবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া, সেরা গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে হ্যাটট্রিক করা- সব মিলিয়ে মমতাজ যেন এক অবাক বিস্ময়কর নাম। সম্প্রতি তামিল নাড়ুর 'গেস্নাবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি' নামের এক ইউনিভার্সিটি থেকে 'ডক্টর অব মিউজিক' সম্মাননা সূচক অর্জন করেন তিনি। অন্যদিকে আগামী ৫ মে তার জন্মদিন। চলমান নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় মমতাজের সঙ্গে।

প্রকাশ | ২৯ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০

জাহাঙ্গীর বিপস্নব
ঘর-সংসারহীন বাউল বাবার হাত ধরেই গানের ভুবনে পথচলা মমতাজের। বাবা মধু বয়াতির ছিল 'নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা'। ছেড়া কাঁথায় শুয়ে কখনো লাখ টাকার স্বপ্ন দেখেননি তিনি। বরং স্বপ্ন না দেখেই যা পেয়েছেন, তা কখনো কল্পনাতেও ছিল না তার। অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো- নাম, যশ, খ্যাতি পেয়ে যান তিনি। কোনোরকম রাখ-ঢাক না করে কত সাবলীল ও অবলীলায় নিজের অতীত জীবনের কথা বললেন তিনি। কথা বলতে বলতেই যেন হারিয়ে গেলেন সেই ছোট বেলায়। বললেন, 'আমার গ্রামের সবাই আমাকে ভালবাসতো। তাতী, জেলে, কৃষক সবাই আমাকে পছন্দ করত, আদর করত। আমার বাড়ির পাশে ছোট্ট একটা নদী আছে। আমি যখন সেই নদীতে গোছল করতে যেতাম. তখন সবাই আমাকে দেখে বলত, ওই যে মমতাজ যায়। অনেকেই পথ আটকিয়ে গান শোনার আবদার করত। অনেকে আবার গান শুনে টাকাও দিত।' কথা বলতে বলতেই আবেগী হয়ে উঠলেন মমতাজ। উদাস ভঙ্গিতে বললেন, আগের সময় আর এখনকার সময় পুরোটা আলাদা। ছোট বেলাটাকে অনেক বেশি মিস করে, বড্ড মনে পড়ে। ছোট বেলার সেই পালা গান, মঞ্চের চারপাশে হাজার হাজার শ্রোতার ভিড়- সব আজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আবার এই তো কিছুদিন আগেই অডিও অ্যালবামের একটা জোয়ার ছিল। প্রায় প্রতিদিনই আমার এক বা একাধিক রেকর্ডিং থাকতো তখন। সেই জোয়ার বিলুপ্তি হয়ে গেল। লাইভ শোর একটা জোয়ার ছিল, অন্যরকম মজা ছিল সেইসব শোগুলোতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু কেমন বদলে গেছে। এখন ইউটিউব এসে সবকিছু আরও সহজ হয়ে গেছে। এখন একটা গান কয়েকবার কেটে কেটে গাওয়া যায়। এখন অনেক শিল্পীরই ইউটিউব চ্যানেল আছে। আমারও একটা চ্যানেল আছে। কিন্তু সেই চ্যানেলটাতে কোনো আপডেট থাকে না। এ কারণে তেমন ও কোনো ফলোয়ারও নেই। সত্যি কথা বলতে, ইউটিউব আমাকে টানে না।' তবে কোনো বাধা-প্রতিবন্ধকতাই গান থেকে দূরে রাখতে পারেনি গানপাগল মমতাজকে। দমিয়ে রাখতে পারেনি তার স্বপ্নকে। গান দিয়েই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। গানেই প্রেম-ভালোবাসা, গানেই বিরহ অনুভব করে চলছেন তিনি। ফলে সংসার জীবনের অস্থিরতা থাকলেও তা সংগীত জীবনের কোনো ছন্দপতন ঘটাতে পারেনি। বরং নিজের সুর আর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যতায় আজ জনমানুষের অতি কাছের মানুষ মমতাজ। পালাগানে শুরু হলেও প্রতিষ্ঠা পান বিচ্ছেদ আর মুর্শিদি গানের মাধ্যমে। কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরেও মেলে ধরেছেন তার এই অসাধারণ প্রতিভা। আবার সংগীত জীবনের বিশালতায় ঠাঁই দিয়েছেন রাজনীতি আর সামাজিক কর্মকান্ডকেও। এত ব্যস্ততার মাঝেও গান ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারেন না মমতাজ। বললেন, 'গান আমার মনের খোরাক। তাই তো এত ব্যস্ততার মাঝেও গানের অনুরোধকে উপেক্ষা করতে পারি না। আমি জোর গলায় বলতে চাই, আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নেই- আমাকে গান গাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে অথচ আমি গান গাইনি। আমি যতই রাজনীতি করি তবুও গানের জগত থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারি না। এখনও টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- যেখান থেকেই গানের অনুরোধ আসুক, আমি না করতে পারি না। গানের জন্য ঠিকই ছুটে যাই সবখানে। গান ছাড়া মমতাজকে কল্পনা করা অসম্ভব।' গান নিয়ে আরও কিছু স্বপ্নের কথা জানালেন মমতাজ। লোকজ এবং পালাগান নিয়েও তার বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। পালাগান নিয়ে যুগ যুগ ধরে যতই বিতর্ক উঠুক, এ নিয়ে একদমই মাথা ঘামান না তিনি বরং এটাকে আধ্যাতিক বিষয় অ্যাখ্যা দিয়ে মমতাজ বলেন, 'পালাগানের বিতর্ক নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এগুলো নির্ভর করে মানুষের বয়স আর চিন্তাধারার উপর। পালাগানের বিষয়বস্তু অনেক গভীর ও মনস্তাত্ত্বিক। যারা পীর-আউলিয়া, তারাই কেবল এর মর্ম উপলব্ধি করতে পারবে।' মমতাজ আরও বলেন, পালাগান, বাউল গান নিয়ে আমার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে। পাশাপাশি বাউলদের জন্য একটা বাউল একাডেমি করেছি। এটা অনেকটা আর্কাইভের মতো। এখানে সব ধরনের লোকগান সংগ্রহ করছি। আমার সরকার ও সংস্কৃতি মন্ত্রণায়ের কাছে সুপারিশ করব, যাতে দেশে যত লোকগান আছে, সব গান এ বাউল একাডেমিতে সংগৃহীত থাকে। লোক সংগীতকে আমি বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে চাই।' সম্প্রতি ভারতের তামিলনাড়ুর গেস্নাবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পাওয়া নিয়ে নতুন করে আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনার শিকার হচ্ছেন মমতাজ। অভিযোগ উঠেছে, যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পেয়েছেন মমতাজ; সেটি বৈধ নয়। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি বিক্রির অভিযোগও উঠছে। এ প্রসঙ্গে মমতাজ বলেন, 'এই বিষয়ে আমার খুব ভালো করে জানা নেই, তবে আমার লোকজন দিয়ে খবর নিয়ে জানতে পারি, সবই ঠিকঠাক। নিজের দেশ হলে সমস্যা ছিল না, বিদেশ বলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয়নি।' এদিকে আগামী ৫ মে মমতাজের জন্মদিন। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারো নিজের জন্মদিন নিয়ে কোনো আয়োজন নেই বলেই জানালেন এ ফোকসম্রাজ্ঞী। জানালেন, জন্মদিন নিয়ে ভাবি না, তাছাড়া বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় জন্মদিন পালন করাটা মোটেও শোভনীয় হবে না। আপনারা সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন আগামীতে যেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আরও কাজ করে যেতে পারি। আর দেশের মানুষকে সুন্দর সুন্দর গান উপহার দিতে পারি। কারণ গান ছাড়া মমতাজ কোনো দিন থাকতে পারবে না। গান আমার রক্তের প্রতিটি কণায় কণায় মিশে আছে। এই গানের জন্যই আজ আমি মমতাজ হয়েছি। নাম যশ খ্যাতি পেয়েছি। সংসদ সদস্য হয়েছি। গান আমার প্রাণের খোরাক।'