বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পূর্ণিমা : আলো আছে আলো নেই

মাতিয়ার রাফায়েল
  ২৯ জুলাই ২০২১, ০০:০০

'করোনার আগে থেকেই নতুন কোনো কাজ করছি না। তার মানে এই নয় যে, কাজ পাচ্ছি না। আসলে কোনো কাজই নিচ্ছি না। তাছাড়া পারিবারিক নিষেধও আছে। সেজন্যও এ বিষয়ে আপাতত নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। মনের মতো গল্পও তো পাচ্ছি না। আর করোনাকালীন কাজ করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ। সব মিলিয়েই নতুন কোনো কাজ নিচ্ছি না। তারপরও সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ- ভালো আছি।'

চলমান সময় ও কাজ নিয়ে এভাবেই বললেন ঢাকাই সিনেমার মিষ্টি চেহারার সুদর্শনী নায়িকা দিলারা হানিফ রিতা ওরফে পূর্ণিমা। জাকির হোসেন রাজুর 'এ জীবন তোমার আমার' দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তার। কাজী হায়াত পরিচালিত 'ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না' ছবিটির জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পূর্ণিমা অভিনীত সবচেয়ে ব্যবসা সফল ছবি 'মনের মাঝে তুমি', 'হৃদয়ের কথা', 'মেঘের পরে মেঘ', 'মনের সাথে যুদ্ধ', 'আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা', 'মাটির ঠিকানা' প্রভৃতি। এক সময়ে অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে থাকা পূর্ণিমা টিভি মাধ্যমেও কাজ করেছেন 'এবং পূর্ণিমা'র পর সম্প্রতি 'পূর্ণিমার আলো' নামক আরও একটি টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। সেই ব্যস্ততা থেকে দূরে থেকে চলমান পরিস্থিতিতে কেমন আছেন, জানতে চাইলে অত্যন্ত নির্বিকারভাবে 'ভালো আছি' বলে খানিকক্ষণ থামেন এ অভিনেত্রী। পরক্ষণেই বলতে শুরু করেন। জানান, এখন 'ভালো আছি' বলার মতো শোবিজের অনেকেরই কাজ নেই। এই কাজ না করার অজুহাত হিসেবে এখন অনেকেই ভালো গল্প না থাকার কথাও বলেন। কিন্তু গল্পের দোষেই নাকি সিনেমাও হচ্ছে না? এমন প্রসঙ্গে পূর্ণিমা বলেন, 'সিনেমা হবেই বা কি করে! দর্শক তো সিনেমা হলে যাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। গত দশ-পনের বছর ধরেই সিনেমাহল থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করে মানুষ। সিনেমা ও প্রেক্ষাগৃহ মালিকরা লোকসান গুনতে থাকেন। মহামারির মতো একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ। যখন থেকে মহলস্নায়, মহলস্নায় স্যাটেলাইট টিভি ও ভিডিও পাইরেসি শুরু হয়, তখন থেকেই সিনেমা হলে দর্শক কমতে থাকে। আর স্মার্টফোন এসে বাকি যেসব সিনেমা হল ছিল, সেগুলোরও পুরো বারোটাই বাজিয়ে দেয়। আমরা যখন সিনেমার অভিনয়ে আসি, তখন সিনেমার সিংহভাগ দর্শক ছিলেন কারা? যারা ৯টা-৫টা চাকরি করেন, তারা তো না। যারা ১৫-১৬ ঘণ্টা দোকানদারি বা ব্যবসা করেন, তারাও না। তারা আরও অনেক আগেই হলে যাওয়া ছেড়ে দেন। বরং রিকশাঅলা, বাস ড্রাইভার, স্কুটার ড্রাইভার আর দলবেঁধে যাওয়া গার্মেন্টশ্রমিক মেয়েরা বা ছেলেরাই ছিলেন আমাদের আসল সিনেমার দর্শক। তারাই আমাদের সিনেমার পোস্টার দেখতেন, ভিউকার্ড দেখতেন। সেই তাদের হাতে এখন স্মার্টফোন; আইফোনও উঠেছে কারো হাতে। আগে যারা দলবেঁধে সিনেমা দেখত এখন তারা বাসায় বা যেখানে-সেখানে বসে যখন তখন আরাম করে যেমন ইচ্ছা তেমন করে একা একা সিনেমা দেখছে। এভাবেই তো আমাদের যারা আসল দর্শক ছিলেন সেই তাদের হারিয়ে বসলাম।'

এই হারানো দর্শক আর ফিরিয়ে আনা যাবে বলে মনে করেন? জবাবে পূর্ণিমা বলেন, 'আমাদের হতাশ হলে তো হবে না। তারপরও আমি মনে করি, দলবেঁধে সিনেমা দেখার সেই দৃশ্যটি আবার ফিরিয়ে আনা জরুরি। কীভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে- এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। সিনেপেস্নক্সে দুইশ'-তিনশ' টাকার টিকিট কেটে কারা যাবেন সিনেমা দেখতে? তার চেয়ে বরং ওই শ্রমিকরা টাকা জমিয়ে স্মার্টফোন কিনছেন, ৫০-৮০ ইঞ্চির এলইডি টিভি কিনছেন। সেটা তো বড় পর্দার চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। মানুষ বড় পর্দায় সিনেমা দেখার আগ্রহও পাচ্ছে না। দলবেঁধে সিনেমা দেখায় যে আনন্দ, মজা ও আকর্ষণ ছিল, সেই আনন্দগুলো যেন এখনকার লকডাউনের মতোই হয়ে গেছে। যে সিনেমা হলে দর্শকই হচ্ছে না- টিকিট কাটতে লাইনও দিতে হচ্ছে না- সেখানে লকডাউন দিলেই কি আর না দিলেই কি। লকডাউন তো দেওয়ারই প্রয়োজন নেই- এই সিনেমাহলে।'

তারপরও যেসব বাণিজ্যিক সিনেমা হচ্ছে তাতে বিশ্বকে দেখা গেলেও দেশকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। এরকম সিনেমা দেশের আপামর দর্শককে টানতে পারবে? পূর্ণিমার উত্তর, 'সে রকম মেধাসম্পন্ন পরিচালক তো আমাদের নেইও। যাদের সিনেমায় দেশকে খুঁজে পাওয়া যাবে। কারণ, যারা দেশীয় রুচির সিনেমা পছন্দ করতেন তাদেরও হলমুখী করা যাবে না। তাই পরিচালকরা এখনকার টিনএজ স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের জন্যই এই বাণিজ্যিক সিনেমা বানিয়ে ওটিটি পস্ন্যাটফর্মে ছাড়ছেন। সেগুলোরই দর্শক আজকালকার ছাত্রছাত্রীরা। এখন এটাই নতুন ধারা। সিনেমার নামকরণগুলোও হচ্ছে এই ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য করে। এই ধারা কতদিন চলবে, সেটাই দেখার বিষয়! এখন এই সিনেমার কোনটা ভালো, কোনটা ভালো না- সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্ট বা লোকমুখ থেকে জানা হয়। এই কমেন্টগুলোর কতগুলো পুরো সিনেমা দেখার প্রতিফলন- তাও জানার উপায় নেই। কারণ বাস্তবের দর্শকচিত্র ভিন্ন কথাই বলে। এ অবস্থায় কারা সিনেমায় অর্থলগ্নি করতে সাহস করবেন?'

অভিষেকের পর থেকে চলচ্চিত্রে দু'দশক পেরিয়েছেন পূর্ণিমা। এক সময় হয়তো নায়িকার চরিত্রে পাওয়া যাবে না তাকে। সে অবস্থায় ভাবী বা মা-খালা জাতীয় কোনো চরিত্রে অভিনয় করবেন? এর জবাবে পূর্ণিমা বলেন, 'সেই সময়টা তো এখনো আসেনি। সে রকম চরিত্রে সুজাতা, শাবানা, কবরী, ববিতা ম্যামও তো কাজ করেছেন। তারপরও মেয়েরা তাদের অভিনয় দেখেই চোখে অশ্রম্ন নিয়ে হল ছেড়েছেন। তেমন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পেলে অবশ্যই করব। কিন্তু ততদিনে বাংলা সিনেমাও বেঁচে থাকুক, সেটাও আমি প্রার্থনা করি।'

ফের অভিনয়ে ফিরলে তিনি কোন ধারার সিনেমাকে গুরুত্ব দেবেন, জানতে চাইলে এ অভিনেত্রী বলেন, 'সিনেমাই তো হচ্ছে কম। এর মধ্যে কী বাছাবাছি করব! তারপরও যেসব সিনেমা সুস্থ ধারার হবে, জীবনঘনিষ্ঠ হবে, দলবেঁধে দেখার মতো হবে, হৃদয়কে স্পর্শ করার মতো ভালো চরিত্র হবে- সে রকম সিনেমাতেই অভিনয় করব।'

অভিনয় জীবনে অর্ধ শতাধিক সিনেমা করেছেন পূর্ণিমা। এর বাইরে নিজের ছবি ছাড়াও আরও বহু সিনেমা দেখেছেন জীবনে। এর মধ্যে কোন সিনেমাগুলো তার পছন্দের? 'আমার নিজের করা সব সিনেমাই ভালো। সবই আমার প্রিয়। কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলব। আর দেশি-বিদেশি যত সিনেমা দেখেছি- সেখানেও কোনটা সেরা, কোনটা পছন্দের- এই বিবেচনা থেকে কোনো সিনেমা দেখিনি। তাই এক্ষেত্রেও আমার পছন্দের তালিকা দিতে পারছি না।' বললেন পূর্ণিমা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে