বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সেই শাকিব এই শাকিব

রাজা যায়, রাজা আসে; কিন্তু আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রে দীর্ঘদিন ধরে এককভাবে রাজত্ব করছেন চিত্রনায়ক শাকিব খান। একসময় শাকিব খানের সিনেমা মানেই অন্যরকম এক উন্মাদনা বিরাজ করত দর্শক মহলে। চলচ্চিত্র মহলেও বিরাজ করত উৎসবমুখর পরিবেশ; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে গেছে অনেক কিছু। কমে গেছে শাকিব-বন্দনাও।
জাহাঙ্গীর বিপস্নব
  ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

বিশ্ব চলচ্চিত্রশিল্পে একটা কথা প্রচলিত আছে, কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো তারকা নাকি টানা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এককভাবে রাজত্ব করতে পারেন না। আধিপত্য হারিয়ে ধীরে ধীরে শীর্ষস্থানটি দূরে সরে যেতে থাকে। এক সময় ওই স্থানটি দখল করে অন্য কোনো তারকা কিংবা নতুন কোনো শিল্পী। কিন্তু বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রচলিত এ কথাটিকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছেন আমাদের ঢালিউড তারকা শাকিব খান। বলতে দ্বিধা নেই, গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজের আলাদা এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। সেখানে তিনি একাই রাজত্ব করছেন এতদিন ধরে। শাকিব সাম্রাজ্যের ধারে-কাছে কেউ নেই। যদি প্রশ্ন করা হয়, শাকিব খানের পর দ্বিতীয় অবস্থান কার? কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। যদি বলা হয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ অবস্থানে কে আছেন? উত্তরে যেন কেবল শাকিব খানের নামই উচ্চারিত হবে অনেকের মনে। পারিশ্রমিকের দিক থেকে এখনো কয়েক ধাপ ওপরে শাকিব খান। ২০০০ সালের পর থেকে প্রয়াত নায়ক মান্নার মৃতু্যর আগে মান্নার পাশাপাশি রিয়াজ, ফেরদৌসেরও একটা জোয়ার ছিল চলচ্চিত্রমহলে। কিন্তু আচমকা রিয়াজ-ফেরদৌসের সেই জোয়ারে ভাটা পড়ে। তখন শাকিব খানও একের পর এক ছবিতে অভিনয় করেছেন বটে, কিন্তু মান্না, ফেরদৌস কিংবা রিয়াজের কাছে পাত্তাই ছিল না শাকিবের। নামসর্বস্ব কয়েকজন পরিচালক এবং নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করতে দেখা গেছে তাকে। এভাবে একটু একটু করে মান্নার মৃতু্যর কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই উত্থান শুরু হয় শাকিবের। সিনেমা মুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যেত মান্না বনাম শাকিব খানের লড়াই। এমনকি ঈদের ছবির মুক্তির ক্ষেত্রেও প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের কাছে চাহিদার তুঙ্গে ছিলেন মান্না-শাকিব।

কিন্তু হঠাৎ করে নায়ক মান্নার মৃতু্য হলে রং বদলায় চিত্রপুরীর। অমিত হাসান, আমিন খান, আলেক জান্ডার বো, শাকিল খানকে অনেক পেছনে ফেলে চলচ্চিত্রের একক আধিপত্য বিস্তার করেন শাকিব খান। ওই সময় শাকিব খানের যে সিনেমাই মুক্তি পায়, সেই সিনেমাই সুপারহিট ব্যবসা করে। শাকিবের ভয়ে এবং ব্যবসায়িক লোকসানের আশঙ্কায় ওই সময় অন্য নায়কের সিনেমা মুক্তি দিতে সাহস পেতেন না সিনেমা ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যেই প্রযোজক ও অভিনেতা মনোয়ার হোসেন ডিপজল শাকিব খানের সঙ্গে নবাগত অপু বিশ্বাসকে জুটি করে 'কোটি টাকার কাবিন' সিনেমা নির্মাণ করেন। প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত করে শাকিব-অপু জুটি। এরপর এ জুটিকে নিয়ে একের পর এক সিনেমা নির্মাণের ধুম পড়ে যায়। তুমুল জনপ্রিয়তাও পায় সেই সিনেমাগুলো। আর ঈদের সিনেমার ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, ৪-৫টি সিনেমা মুক্তি পেলে তার সবগুলোই শাকিব খানের। প্রায় ঈদেই পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ পেত, 'শাকিবের প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু শাকিব' এমন শিরোনামে। পরবর্তীতে দেখা গেছে, কেবলমাত্র অপু বিশ্বাসের সঙ্গেই নয়, যে নায়িকার বিপরীতেই তিনি অভিনয় করেছেন, সব সিনেমাই সুপার কিংবা সুপার-ডুপারহিট ব্যবসা করেছে। এ কারণে তার নামের সঙ্গে 'কিং খান', ভাইজান, 'নাম্বার ওয়ান'সহ নানা রকম তকমা জুড়ে দেন অনেকে। শাকিব খানের একচেটিয়া আধিপত্যের জন্য এক সময় আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক নেন তিনি। তর তর করে ২০ লাখ থেকে ৩০, ৩৫, ৪০ এমনকি ৫০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নেন তিনি। শুধু তাই নয় সর্বশেষ ৬০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক দিয়েও সিনেমা নির্মাণের জন্য ভোর সকালে শাকিব খানের বাসায় অপেক্ষা করতেন নামি-দামি সব নির্মাতা। এমনও হয়েছে দুই-বছরের জন্য শিডিউল খাতা বন্ধ ছিল শাকিবের।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলে যায়। বদলে গেছে শাকিব খানও। নানা কারণে গত কয়েক বছরে দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্পে বড় ধরনের ধস নেমে আসে। বিশ্বায়নের যুগে কমতে শুরু করে সিনেমা হলে গিয়ে দর্শকের সিনেমা দেখার সংখ্যা। যে শাকিব খানের সিনেমা দেখার জন্য দর্শকের উপচেপড়া ভিড় দেখা যেত, সেই শাকিব খানের সিনেমাও এখন পড়ে যাচ্ছে ব্যর্থতার কবলে। পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন বছরে একমাত্র মালেক আফসারী পরিচালিত 'পাসওয়ার্ড' ছাড়া কোনো সিনেমাই আহামরি ব্যবসা করতে পারেনি। এর মধ্যে দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে করোনার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে চলচ্চিত্রশিল্প। চলচ্চিত্রের স্বার্থে নিজের পারিশ্রমিক অর্ধেকে নামিয়ে আনলেও শিডিউলের জন্য আগের মতো আর ভিড় জমাচ্ছেন না নির্মাতারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতে মাত্র কয়েকটি সিনেমা রয়েছে শাকিব খানের। এখন চলচ্চিত্রের এই মন্দা বাজারে কমে গেছে সিনেমার বাজেট। এই বাজেটে শাকিব খানকে নিয়ে সিনেমা বানাতে সাহস পাচ্ছেন বেশিরভাগ লগ্নিকারক। তিনি নিজেও একজন লগ্নিকারক। কিন্তু তিনি নিজেও ঝুঁকি নিচ্ছেন না। বরং কম বাজেটের সরকারি অনুদানের সিনেমাতেও অভিনয় করতে হচ্ছে তাকে। এসব বিষয়ে শাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তিনি বলেন, 'এখানে আমার কি বক্তব্য থাকবে! গোটা চলচ্চিত্রেরই তো ভগ্নদশা। শুধু আমাদের চলচ্চিত্র কেন, বিশ্ব চলচ্চিত্রেরও একই দশা। চলচ্চিত্রের জন্য আমি যতটুকু ছাড় দেওয়ার দিয়েছি। বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে যা করা প্রয়োজন, সবই আমি করব। আমি চলচ্চিত্রেরই মানুষ। চলচ্চিত্রই আমাকে শাকিব খান বানিয়েছে। চলচ্চিত্রই আমার বাড়ি-ঘর। আমাদের সবার উচিত, এই পরিবারটিকে আগলে রাখা। সুদিন নিশ্চয়ই আসবে আবার।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে