ব্যতিক্রম কেবল মেহরীন

এক এক করে ক্যারিয়ারের ২২টি বছর পার হলো। এই লম্বা সফরে তার সম-সাময়িক বা অনেকেই গান নিয়ে লম্বা রেসের দৌড়ে থমকে গেছেন। কিন্তু সপ্রতিভা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে এখনো সুনাম ও সম্মানের সঙ্গে টিকে আছেন মেহরীন মাহমুদ। মঞ্চ, পরিবার এমনকি মানবতার সেবাÑ সবের্ক্ষত্রেই তিনি একই রকম। যা করেন মন ভালোলাগা, ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ থেকে করেন। তাই তো কোনো কিছু থেকে প্রাপ্তি খেঁাজেন না। খেঁাজার চেষ্টাও করেন না।

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০

জাহাঙ্গীর বিপ্লব
মেহরীন মাহমুদ
মেহরীন মাহমুদ। নাম শুনলেই এক ধরনের নরম কোমল মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ছবির মতোই ভদ্র, শান্তশিষ্ট মেয়ে তিনি। কারো সাতে নেই, পঁাচেও নেই। নেই কোনো গুজব কিংবা গুঞ্জন। আর দশ জন কণ্ঠশিল্পীদের মতো হুট-হাট অ্যালবাম বের করা অথবা হঠাৎ আলোড়ন তুলে আচমকাই নিভে যাওয়ার স্বভাব নেই তার। তার স্বভাব একটু ভিন্ন মেজাজের। গান গেয়ে বাজারে হই চই ফেলে দিতে হবে, এমনকি টাকা উপাজর্ন করতে হবেÑ এমন মনোভাবও কখনো ছিল না তার। তার গানের ভঙ্গি ও গান গাওয়ার ভঙ্গিমাও অনেকটা আলাদা ঘরনার। তাই তো নিজস্ব স্বকীয়তায় অনেকটা বহতা নদীর মতই এগিয়ে চলছেন তিনি। পত্রপত্রিকাতে বড় বড় খবর আর ছবি প্রকাশের ব্যাপারেও অনাগ্রহ তার। তাই তো কথামালার শুরুতেই একগাল হেসে বললেন, ‘দেখেন ভাই, ইনিয়ে-বিনিয়ে গুনগান করার দরকার নেই। যা সত্যি, যতটুকু প্রযোজন ততটুকুই লিখবেন। অহেতুক প্রশংসা না করলেই খুশি হব। আমি আবার এসবে খুব বিব্রতবোধ করি।’ বিনয়ী বলেই হয়তো এমনটি বললেন তিনি। সম্প্রতি মেহরীনের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর একটি ক্লাবে। ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় মেহরীনের একক সঙ্গীত সন্ধ্যা। যেখানে আগত অতিথির মধ্যে ছিলেন ভারত থেকে আসা একদল উচ্চপযাের্য় বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদল। তাদের সঙ্গে নিয়ে একক সঙ্গীত উপভোগ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হষর্ বধর্ন শ্রিংলা, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু, ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতি কেন্দ্রে নবনিযুক্ত পরিচালক নীপা চৌধুরী, গুলশান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট শওকত আজিজ রাসেল প্রমুখ। মেহরীন মঞ্চে আসেন শুদ্ধতা ও শান্তির প্রতীক সাদা পোশাকে। শুরুতেই শুভেচ্ছা বিনিময় করে গাইলেন দেশের গান ‘ধন ধান্য পুষ্পভরা’। এরপর গানের ঝঁাপি খোলেন তিনি। শোনালেন গোটা বিশেক বাংলা, ইংলিশ ও হিন্দি গান। রবি ঠাকুর, নজরুল ও আব্বাউদ্দীনের গানও ছিল একটি করে। গানে গানে সঙ্গীত সন্ধ্যা পেঁৗছে যায় গভীর রাত পযর্ন্ত। গান শেষেই ক্ষান্ত হন না মেহরীন। ঘমার্ক্ত আর ক্লান্ত শরীরেই ঘোর লাগা চোখে হাসিমুখে আমন্ত্রিত অতিথির সেলফিতে অংশ নেন মেহরীন। সেলফি পবর্ শেষ করে তারার মেলার মুখোমুখি হলেন মেহরীন। অনেকটা তাড়াহুড়ার ভঙ্গিমায় অনুরাগের স্বরে মেহরীন বললেন, ‘১০ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না ভাই।’ যদিও কথায় কথায় ১০ মিনিট ছাপিয়ে কখন যে তা ঘণ্টার কাছাকাছি পৌঁছে যায়Ñ তা যেন কেউই টের পাইনি। আড্ডা ভাঙে মেহরীনের স্বামী ইন্তেখাব মাহমুদ আর দুই ছেলেমেয়ের অনুরোধে। শুরু থেকেই শুরু করা যাক। আড্ডা শুরু হয় মেহরীনের নতুন অ্যালবাম ‘বন্ধুতা’ নিয়ে। তিনি জানালেন, ‘এরই মধ্যে অ্যালবাম সম্পন্ন হয়েছে। প্রচ্ছদের কাজ প্রায় শেষ। এই অ্যালবামের প্রচ্ছদ এঁকেছেন চিত্রশিল্পী আবদুল মান্নান। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ইউটিউব চ্যানেল ‘গো গালর্’-এ অ্যালবামটি অবমুক্ত করে দেবেন শ্রোতাদের জন্য এমনটাই জানালেন মেহরীন। অ্যালবামটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পঁাচটি করে মোট ১০টি গান দিয়ে। মেহরীন বলেন, ‘আব্বাসউদ্দীন একাডেমির প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলাম আমি। তখন থেকে আমার শিক্ষকরা উৎসাহ দিতেন। তারা বলতেন, গানের কোনো নিদির্ষ্ট সীমারেখা নেই। শিল্পী হতে হলে সব ধরনের গান জানতে হবে। আমি ভেবে দেখলাম তাদের কথাই সত্যি। অনেকেই রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করেন। অনেকেই আবার নজরুলের সুরে বিমোহিত থাকেন। আমি চিন্তা করলাম কবিদের নান্দনিক বিভেদকে কিভাবে বন্ধুত্বে রূপান্তর করা যায়। নমস্য এই দুই কবি নিয়ে ভাবলাম কি করা যায়। অন্বেষণ করা শুরু করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম দুই কবির গান নিয়ে একটি অ্যালবাম করব। তারপর কি আর, করে ফেললাম। রবীন্দ্রনাথের সুরের প্রতি আমার আলাদা মোহ আছে। অথচ অ্যালবামে গানের রেকডির্ংয়ের সময় নজরুলের গানগুলোই ওয়ান টেকে ওকে হয়।’ গতানুগতিক প্রশ্ন-উত্তরের বাইরে ব্যক্তি জীবনের টুকরো টুকরো গল্পও উঠে আসে সেই আড্ডায়। মেহরীন বলেন, ‘বাবা যখন খুব অসুস্থ তখন বিমষর্ থাকতাম। বিমষর্ কাটাতে শাহবাগে নজরুলের সমাধি পাশে চুপচাপ বসে থাকতাম। বাবাকে নিয়ে চিন্তার রেশে মন যখন তটস্থ তখনই এখানে এসে একটু হলেও আলাদা মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পেতাম।’ ফ্রাঞ্চাইজি রিয়েলিটি অনুষ্ঠান ‘বাংলাদেশ আইডলে’র অন্যতম বিচারক ছিলেন মেহরীন। রিয়েলিটি শো থেকে উঠে আসা এসব শিল্পীদের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘এভাবে নতুন নতুন শিল্পী তৈরির কারণে অনেকেই এখন সংগীতের দিকে ঝুঁকছেন। এটা ভালো দিক। সুরের পাশাপাশি গানকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন।’ একজন শিল্পীর গানকে পেশা হিসেবে নেয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখেন মেহরীন। তবে সব ক্ষেত্রে বিষয়টি ইতিবাচক নয় বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘রিয়েলিটি শোয়ের মাধ্যমে যারা উঠে আসছেন তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ তারা এখন ইউটিউবের প্লাটফমর্ ভালো বুঝেন। নিজেরাই জনপ্রিয় হয়ে আয়ের পথ বের করে নেন। কিন্তু আগের যারা সিনিয়র শিল্পীরা আছেন তারা এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আজ তারা না পাচ্ছেন অথর্, এমনকি তারা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাচ্ছেন না।’ শিল্পীদের সম্মান, অথর্-বৈভবসহ নানা প্রসঙ্গ তুললে মেহরীন জানান, ‘আমি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় কনসাটর্ করেছি। সে সব দেশে শিল্পীদের বেশ মযার্দা দেয়া হয়। বিশেষ করে এমআইপি (মোস্ট ইমপট্যান্ট পারসন) সুবিধা দেয়া হয়। সরকার থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন শিল্পীরা। বাংলাদেশে কয়েক খাতে এ রকম প্রথা থাকলেও শিল্পীদের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো সুবিধা নেই। আমি মনে করি, এ রকম ব্যবস্থা করা দরকার। অন্যান্যরা পেলে আমরা কেন পাব না। আমরাও তো মানুষের জন্য, দেশের জন্য গাই।’ গানের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন তিনি। নেমে পড়েছেন দৃষ্টিহীনদের চোখের দৃষ্টি প্রদীপ জ্বালাতে। নিজেও মরণোত্তর চক্ষুদান করেছেন। ‘সন্ধানী’র সহযোগিতায় দেশের নানা প্রান্তে ছুটে যাচ্ছেন ‘আই ক্যাম্প’ নিয়ে। এ ছাড়াও ‘উইমেনস ফেডারেশন ফর ওয়াল্ডর্ পিস’ এর বাংলাদেশ শাখার সভাপতি মেহরীন। সংগঠনটির প্রতিনিধি হয়ে তিনি দঁাড়াচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে। মেহরীন বলেন, ‘আমার ইচ্ছা সব সময়ই কোনো না কোনোভাবে নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দঁাড়ানো। তাদের অসুবিধাগুলো দূর করা। এ জন্য আমাদের একটি স্কুল কমর্সূচি রয়েছে। এর আওতায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনা করানোসহ নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়।’