শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমাত্রিক এক নগরবাউল

ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। কিন্তু তার নাম কিংবা উপাধির কোনো শেষ নেই। কত রকম বিশেষণ তার। কেউ বলেন নগরবাউল, কেউ বলেন বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। ভক্তদের কাছে তিনি 'গুরু' নামে পরিচিত। আবার কারো কারো কাছে 'বোহেমিয়ান রকস্টার' উপাধিতেও ভূষিত তিনি। এত কিছুর পর আরও একটি পরিচয় আছে তার। ক্যামেরার কবি কিংবা শখের ফটোগ্রাফার হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন। আমরা কেবল তার মঞ্চ মাতানো কিংবা তার দরাজ কণ্ঠের গানে ভক্তদের মাতোয়ারা হতে দেখেছি, কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর মানুষটির প্রকৃতি প্রেম আর ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ কমই লক্ষ করেছি। বিশেষ করে করোনাকালে অনেক আলোচিত অভিনেত্রীর আকর্ষণীয় ছবি তুলে খুব সহজেই প্রশংসায় ভেসেছেন তিনি...
জাহাঙ্গীর বিপস্নব
  ০৬ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

প্রায় দুই বছর ধরে গান-বাজনা থেকে নিজেকে দূরে সরে রেখেছিলেন। নতুন গান, কনসার্ট, টিভি প্রোগাম, পেস্ন-ব্যাক- কোথাও দেখা মেলেনি তার। কেবল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানসহ কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। তবে গত বছরের শেষপ্রান্তে করোনার প্রকোপ অনেকটা শিথিল হওয়ায় ফের চেনা ছন্দে ফিরতে শুরু করেছিলেন উপমহাদেশের এই রক লিজেন্ড। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত ডিসেম্বরে সবকিছু যখন খুলে দেওয়া হলো, তখন শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক কনসার্টগুলোই নয়, সারাদেশেই তিনি ছুটে চলেছেন। অংশ নিয়েছেন করপোরেট শো থেকে শুরু করে খোলা মঞ্চে আয়োজিত কনসার্টগুলোতেও। বলা চলে দম ফেলার ফুরসত পেতেন না। এমনকি একদিনে একাধিক কনসার্টেও অংশ নিয়েছেন। চলতি বছরে অনেকগুলো শো করার কথা থাকলেও মঙ্গলবার ওমিক্রন ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে ১৫টি নির্দেশনায় ফের থামাতে হচ্ছে তার গানের মিশন।

নাম তার ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। কিন্তু তার নাম কিংবা উপাধির কোনো শেষ নেই। কত রকম বিশেষণ তার। কেউ বলেন নগরবাউল, কেউ বলেন বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। ভক্তদের কাছে তিনি গুরু নামে পরিচিত। আবার কারো কারো কাছে 'বোহেমিয়ান রকস্টার' উপাধিতেও ভূষিত তিনি। এত কিছুর পর আরও একটি পরিচয় আছে তার। ক্যামেরার কবি কিংবা শখের ফটোগ্রাফার হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন। আমরা কেবল তার মঞ্চ মাতানো কিংবা তার দরাজ কণ্ঠের গানে ভক্তদের মাতোয়ারা হতে দেখেছি, কিন্তু মঞ্চ থেকে নেমে আসার পর মানুষটির প্রকৃতি প্রেম আর ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ কমই লক্ষ করেছি। বিশেষ করে করোনাকালে অনেক আলোচিত অভিনেত্রীর ছবি আকর্ষণীয় ছবি তুলে খুব সহজেই প্রশংসায় ভেসেছেন তিনি। জেমস যে এত ভালো ছবি তুলতে পারেন- তা অজানাই ছিল অভিনেত্রী জয়া আহসান, রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা এবং উপস্থাপক মারিয়া নূরের মতো অনেক তারকার। করোনার সময় জেমসের তোলা তাদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে নিজেদের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন তারা।

তবে এত পরিচয়, এত জনপ্রিয়তা- কোনো কিছু নিয়েই উচ্ছ্বাস নেই কম কথা বলা স্বভাবের এই নগরবাউলের। সর্বদাই গম্ভীর মুখে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায় তাকে। তবে গান কিংবা স্টেজ শো'র ক্ষেত্রে চিত্রটা একেবারেই পাল্টে যায়, বদলে যায় জেমসের চোখমুখ। গম্ভীরতার খোলস থেকে বেরিয়ে অন্যরকম এক উন্মাদনায় মেতে ওঠেন তিনি। আর সেই উন্মাদনায় উন্মাতাল এক ঝংকারে বুঁদ হয়ে ওঠেন ভক্ত-শ্রোতারা। তাদের কাছে জেমস মানেই যেন বাড়তি বিনোদন, ভিন্নমাত্রার উলস্নাস-উচ্ছ্বাস। নগরবাউল জেমস বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে পৌঁছে দিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। ভিন্নধর্মী ব্যক্তিত্ব সুর ও গায়কিতে তরুণ প্রজন্মকে মাতিয়ে রেখেছেন কয়েক দশক ধরে। আবার তার গান সর্বজনীনও। সে জন্যই দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও নন্দিত হয়েছে তার সুরের মূর্ছনা।

ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এভাবেই ভক্ত-শ্রোতাদের মাত করে আসছেন এ তারকা। কতটি গান করেছেন এ যাবত? কতগুলো স্টেজ শো করেছেন- গুণে শেষ করতে পারেন না তিনি। শুধু তাই নয়, এক জীবনে কতগুলো পুরস্কার অর্জন করেছেন, সেটাও তিনি বলতে পারলেন না বেশ জাতীয় টানা কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এ তারকা। তবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মতো বড় কোনো অর্জনই যেন ভাবের কোনো পরিবর্তন এনে দিতে পারে না তার। এমনকি প্রচার-প্রচারণার বিষয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। পছন্দ করেন না অহেতুক কথা-বার্তাও। গান নিয়েই যেন তার সব চিন্তাচেতনা। সুর, লয়, তালই যেন তার একমাত্র ধ্যান-ধারণা। করপোরেট এই সময়ে যখন খ্যাতি আর সুনামের পেছনে ছুটছে গোটা পৃথিবী তখন স্রোতের বিপরীতে নিজেকে নিয়ে ভীষণ খুশি প্রচারবিমুখ ও আত্মকেন্দ্রিক এ মানুষটি। সংবাদ মাধ্যম বিমুখী এই মানুষটার কাছে নামকরা সাংবাদিকরা সময় না পেয়ে বারবার হতাশ হয়েছেন, অথচ কত সবালীলভাবে তিনি ভক্তদের কাছে টেনে নিয়েছেন, ভালোবাসায় সিক্ত করেছেন বারবার! 'ভক্তরা আছে বলেই আমি জেমস' বলে নিজেকে শুধু আমাদের জন্যই বিলিয়ে দিয়েছেন উপমহাদেশের বরেণ্য এই রকলিজেন্ড। জেমসের ব্যান্ড (ফিলিংস ও নগরবাউল) থেকে প্রকাশিত অ্যালবামগুলো হচ্ছে- স্টেশন রোড, জেল থেকে বলছি, নগরবাউল, লেইস ফিতা লেইস ও দুষ্ট ছেলের দল। আর একক অ্যালবামের মধ্যে আছে অনন্যা, পালাবে কোথায়, দুঃখিনী দুঃখ করো না, ঠিক আছে বন্ধু, আমি তোমাদেরই লোক ও জনতা এক্সপ্রেস ইত্যাদি।

জেমসের এসব গানের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে- যা অন্যদের গানে নেই। এই বৈশিষ্ট্যগুলোই জেমসকে নিয়ে গেছে সব রকম শ্রোতার কাছে। ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত, নারী-পুরুষ, শহর-গ্রাম সবার কাছে জেমস হয়ে উঠেছেন গুরু। এর কারণ জেমসের গানের সর্বজনীনতা। কনডেম সেলে আটক ফাঁসির প্রহর গুনতে থাকা আসামি, ভাড়ায় খাটা পেশাদার খুনি, গ্রামের হাটে মলম বিক্রি করা মান্নান মিয়া, গার্মেন্টসে কাজ করা নারী শ্রমিকরা (সেলাই দিদিমণিরা), সব হারা একজন জুয়াড়ি, লিডার (নেতা), নাটোর স্টেশন রোডের দরিদ্র পতিতা জরিনা বিবি, মাতাল শারাবী, রিকশাওয়ালা, গ্রামের মেয়ে হুমায়রা, রাজার দরবারের নর্তকী মীরা বাই, বিরোধী দলের অবরোধের সময়ে প্রেম- কিছুই বাদ নেই জেমসের গানের বিষয় থেকে। গানের বিষয় নির্বাচনে জীবন সম্পর্কে তার গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিচিত্রময়তাই প্রশ্রয় পেয়েছে। তার সুরেও আছে বৈচিত্র্য- যা ছুঁয়ে যায় নগর, গ্রাম, টলিউড, বলিউডসহ সব রকমের শ্রোতাদের। জেমস হতাশায় ডুবে থাকা মানুষকে আশার বাণী শুনিয়েছেন। হতাশ হয়ে কেউ দিনের পর দিন মনমরা হয়ে থেকেছেন। কেউ মাদকের দিকে হাত বাড়িয়েছে, কেউ আত্মহত্যা করেছেন; কিংবা করেছেন ভয়াবহ অপরাধ। এই হতাশ মানুষগুলোর দিকে জেমস হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রগাঢ় মমতায় গেয়েছেন, 'নীরবে অভিমানী নিভৃতে করেছ তিলে তিলে নিজেকে শেষ? কেন বলো পৃথিবীতে কেউ কারও নয়, হয়ে গেছে ভালোবাসা নিঃশেষ। বন্ধু ভেঙে ফেল এই কারাগার খুলে দাও খুলে দাও এ হৃদয়ে প্রেমেরই দ্বার'। অথবা 'দুঃখের পৃষ্ঠা উল্টে দেখ স্বপ্নের বাগিচা, ঘরে বসে থেকে লাভ কি বলো? এসো হাতে হাত রাখি এসো গান করি। দুঃখিনী দুঃখ করো না...দুঃখিনী...দুঃখিনী'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে