জমে উঠেছে স্টার জলসা

স্টার জলসার ‘ফাগুন বউ’ সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছেন ঐন্দ্রিলা সেন

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০

জাহাঙ্গীর বিপ্লব
-‘আমার স্টার জলসা দে, ইরাবতীর চুপকথা শুরু হয়ে গেছে।’ তামজীদকে (ছদ্মনাম) এভাবে আদেশ করেন তার মাসেরাজুম মনিরা (ছদ্মনাম)। তামজীদ আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের খেলা দেখছি, মা।’ -‘পরে দেখিস, পড়তে যা।’ বলেই টেলিভিশনের রিমোটটি করায়ত্ত করলেন সেরাজুম মনিরা। বোতাম টিপে চালু করেন স্টার জলসা চ্যানেল। সেরাজুম মনিরা প্রতিদিন ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল স্টার জলসায় গোটা দশেক সিরিয়াল দেখেন। গড়ে একটানা পঁাচ ঘণ্টা সিরিয়াল দেখেন। রাত সাড়ে ১১টায়ও তার পছন্দের একটি সিরিয়াল আছে, কিন্তু সকালে উঠতে হয় বলে এটি বাদ দেন। এভাবে প্রতিদিনের সিরিয়ালের ধারায় বঁাধা পড়েছেন । তামজীদের ভাষ্য, ‘আগে ইংলিশ ছবি দেখতাম, খেলা দেখতাম। ঈদের সময় নাটক ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখতাম। বিভিন্ন সময় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা হয়। এখন এসবের কিছুই দেখার সুযোগ হয় না। সারা বছরই শুধু স্টার জলসা।’ তামজীদের ছোট বোন তৈয়বা চুতথর্ শ্রেণিতে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে মায়ের সঙ্গে সিরিয়াল দেখার অভ্যাস করে ফেলেছে। স্টার জলসার সিরিয়ালগুলোর নাম জানতে চাইলে তৈয়বা জানাল, মার সবচেয়ে বেশি পছন্দ ফাগুন বউ, ইরাবতীর চুপকথা। সেরাজুম মনিরার ভাষ্য, ‘সন্ধ্যা থেকে সিরিয়াল দেখি বলে আগেই ঘরের কাজকমর্ সেরে রাখি। বিদ্যুৎ বা অন্য কোনো কারণে কোনো সিরিয়ালের কোনো পবর্ মিস হলে দিনের বেলা দেখে পুষিয়ে নেই।’ ঘটনাটি গাজীপুর কাপাসিয়াতেই নয়, এমন চিত্র এখন বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে। শহর থেকে গ্রাম-গ্রামান্তরে। ছেলে-বুড়ো সব বয়সী দশর্কদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ নিয়ে নিমির্ত এসব নাটক দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন দেশের নারীক‚লের সিংহভাগ অংশ। অনেকেই সন্ধ্যা হতে না হতেই হাতের কাজ গুছিয়ে নিয়ে বসে পড়েন টিভি সেটের সামনে। ইরাবতীর চুপকথা, ভজ গোবিন্দ, কে আপন কে পর, প্রতিদানসহ একটানা বেশ কয়েকটি সিরিয়াল দেখে ফেলেন তারা। এক পবর্ না দেখতে পারলে পাশের বাসার কারো কাছ থেকে ঘটে যাওয়া দৃশ্যের বিবরণ শুনতে চান। শুধু শুনেই ক্ষান্ত নন, অপেক্ষায় থাকেন পরেরদিন দিনের বেলায় পুনঃপ্রচার দেখার জন্য। আন্তজাির্তক সংস্থার জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে অনেক বিনোদনমূলক টিভি চ্যানেল থাকলেও, জনপ্রিয়তার দিক থেকে যথাক্রমে তৃতীয় এবং সপ্তম রয়েছে স্টার জলসা এবং জি বাংলা। ভারতীয় বাংলা এই চ্যানেলগুলোর মূল আকষর্ণ নাটক এবং কিছু রিয়েলিটি অনুষ্ঠান। তবে সবচেয়ে বেশি জমে উঠেছে স্টার জলসার সিরিয়াল। কেন এত আগ্রহ! এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছুটা চিন্তাভাবনা করছেন সাধারণ দশর্করা। ঠিক কি কারণে স্টার জলসায় মগ্ন থাকেনÑ এক কথায় প্রকাশ করতে পারেননি তারা। দশকের একাংশ জানালেন, আহামরি কিংবা বিশেষ না থাকলেও কেন যেন এগুলো দেখতে মন চায়। এমনকি কাল্পনিক এবং বাস্তব বিবজির্ত সিরিয়ালও রয়েছে তাদের পছন্দের তালিকায়। দশের্কর আরেক অংশ বলছেন, এসব সিরিয়ালগুলো দেখতে কেমন যেন একটা মোহ কাজ করে। দৃশ্যের পর দৃশ্যগুলো ক্রমশ যেন আগ্রহী করে তোলে তাদের। তাদের কথা হচ্ছে, বিনোদন হচ্ছে মনের খোরাক। সেই বিনোদন চিত্তে দুদÐ শান্তি দিতে পারছে কিনা! তবে অভিযোগও আছে দশের্কর। বিজ্ঞাপন বিরতি নিয়ে তেমন একটা অভিযোগ না তুললেও ঘন ঘন বিরতিতে বিরক্তি আসে বলে জানিয়েছেন এসব সিরিয়ালের নিয়মিত দশর্করা। বলছেন, প্রতিটি দৃশ্যে বারবার আলাদা আলাদাভাবে অভিনয়শিল্পীদের মুখ দেখানোকে অহস্য মনে হয় কখনো কখনো। এদিকে এসব স্টার জলসা নিয়ে নানা কথামালা উড়ে বেড়াচ্ছে শোবিজের আকাশে। এটাকে সংস্কৃতির আগ্রাসন উল্লেখ করে এসব সিরিয়ালের বিরোধিতা করতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের অনেক তারকাকে। তারা ঢালাওভাবে মন্তব্য করছেন, এগুলো আমাদের বাস্তবতার পরিপন্থী। এসব সিরিয়ালের কারণে পরকীয়ায় আসক্তের পাশাপাশি বিবাহ বিচ্ছেদের পথে ঝুঁকছেন দেশের নারীরা । অনেক নিমার্তারাও এমন অভিযোগ তুলছেন। তারা না দেখেই ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ সম্পকের্র প্রসঙ্গ টানছেন। যদিও বতর্মান সময়ে স্টার জলসাসহ ভারতীয় বাংলা চ্যানেলে যেসব সিরিয়াল প্রচারিত হচ্ছে, যেগুলোতে অসম প্রেম কিংবা পরকীয়ার ঘটনা নেই। বেশিরভাগ নাটকেই পারিবারিক দ্ব›দ্ব আর হিংসা-বিদ্বেষের চিত্র উঠে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশে এত চ্যানেলে প্রতিদিন এতগুলো নাটক প্রচারিত হলেও কোন নাটকটি দশের্কর পছন্দের তালিকায় রয়েছে? কোন নাটকের জন্য সময় গুনে গুনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে? কোন নাটকটি দেখতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করছেন? উত্তরে কোনো নামই উচ্চারণ করতে পারছেন না দশর্ক। ভারতীয় সিরিয়ালের প্রতি বাংলাদেশি দশের্কর আগ্রহ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে এখন অনেকটা এমন দঁাড়িয়েছে যে, বিজ্ঞাপনের ফঁাকে ফঁাকে নাটক দেখানো হয়। বাংলাদেশে যে হারে যে হারে নাটক তৈরি হচ্ছে, সে হারে অভিনেতা বা কলাকুশলী তৈরি হয়নি।’ প্রবীণ অভিনেতা এবং নিমার্তা মামুনুর রশিদ বলেন, ‘ভারতীয় নাটকে যারা অভিনয় করে তাদের আলাদা একটি গ্রæমিং সেন্টার আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়াও যারা ভালো অভিনয় করে, তাদের অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। আর বেশি টাকা দিতে হয় বলে ভালো অভিনেতাদেরও নিমার্তারা নিচ্ছে না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ও অভিনেত্রী ওয়াহিদা মল্লিক জলি বলেন, ‘ওরা সিরিয়ালের একটি ভাষা বের করেছে। একটু উচ্চগ্রামের, উচ্চস্বরে কথা বলা, বিস্তৃত একটা সুর আছে তাদের নাটকে। বাঙালি কিন্তু এই সুর ভালোবাসে। আর ওরা যেভাবে গল্পটা বলতে পারে তাতে প্রতি মুহূতের্ কৌত‚হলটা উদ্রেক হয়।’