বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন আছেন হানিফ সংকেত

৩০ বছর ধরে চলে আসা 'ইত্যাদি'র মাধ্যমে হানিফ সংকেত সমাজের নানা প্রচলিত অসঙ্গতির বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠ রাখেন। 'ইত্যাদি'র প্রতিটি পর্বে সমসাময়িক নিন্দিত ঘটনার বর্ণনা ও বিরোধিতা থাকে কিছুটা রম্য হলেও দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে। তাই বিবিসিসহ দেশের প্রতিটি জরিপেই দেখা গেছে, 'ইত্যাদি' দেশের সেরা টিভি অনুষ্ঠান এবং দেশের ৭৫ শতাংশ টিভি দর্শক এই অনুষ্ঠান দেখে থাকে
ম মাসুদুর রহমান
  ০৯ জুন ২০২২, ০০:০০

'এই মিলনায়তনে এবং মিলনায়তনের বাইরে যে যেখানে বসে আমাদের এই অনুষ্ঠান দেখছেন, সবাইকে সাদর সম্ভাষণ।' এরপর মিলনায়তনের দর্শকের করতালি। করতালি শেষে আবারও উপস্থাপকের বক্তব্য, 'প্রীতি নিন, শুভেচ্ছা নিন।'

পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নেই, কোন অনুষ্ঠান এবং কোন উপস্থাপকের কথা বলা হচ্ছে। যিনি কথার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলেন দর্শকদের। কথার সেই জাদুকর, প্রাণোচ্ছল অথবা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি বর্তমানে ব্যক্তিগত কাজে আমেরিকায় রয়েছেন। সেখানে প্রায় এক মাস বিভিন্ন কাজ-কর্ম সেরে ফিরে আসবেন বাংলাদেশে। দিব্যি সুস্থ দেহ-মন নিয়ে সশরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পথ-প্রান্তরে। অথচ বহুল জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি'র নির্মাতা ও নন্দিত উপস্থাপক হানিফ সংকেত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন- এমন খবর শুনে কে না আঁতকে উঠবেন? হঁ্যা, এরকমই এক উদ্ভট ও আজগুবি খবরে ভারী হয়ে গিয়েছিল মিডিয়ার আকাশ। গত ২৪ মে রাতে হঠাৎ এমন ভিত্তিহীন খবর রটেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টিকটক, ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার নানা পেজ ও ব্যক্তিগত আইডি থেকে এ ভুয়া তথ্যের খবরটি ছড়ানো হয়।

অংড়ভঁফফড়ষিধ ঔববিষ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে লেখা হয়েছে 'শোক এবং শ্রদ্ধা, জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির উপস্থাপক, প্রযোজক ও নির্মাতা বিশিষ্ট গুণীজন হানিফ সংকেত আজ সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি।' 'দুর্গাপুর উপজেলা প্রচার দল' নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে লেখা হয়েছে, শোক সংবাদ, সবার সুপরিচিত মুখ ও জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির প্রযোজক, উপস্থাপক, ব্যবস্থাপক, আয়োজক খ্যাতিমান ও স্বনামধন্য হানিফ সংকেত আজ সকালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করিয়াছেন। ঝরুধফধঃ জধল নামে আরেকটি আইডি থেকে লেখা হয়েছে, 'জনপ্রিয় উপস্থাপক ইত্যাদির হানিফ সংকেত দুর্ঘটনায় মারা গেছেন (ইন্না লিলস্নাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। একটি নক্ষত্রের সমাপ্তি হলো।' এই কয়েকটি খবর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে নেট দুনিয়ায়। রাত শেষে দিনের আলোয় সব কিছু উদ্ভাসিত হতে না হতেই শোরগোল পড়ে মিডিয়াঙ্গনসহ সারাদেশে। ভক্তরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন এই দুঃসংবাদে। নিজেকে নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক এমন খবরে বিরক্ত ও বিব্রত হন হানিফ সংকেত। অবশেষে নিজের ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাজ দিয়ে প্রমাণ করেন তিনি বেঁচে আছেন। ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেন তাকে ঘিরে মৃতু্যর গুঞ্জন নিয়ে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া। যেখানে তিনি হতাশা ব্যক্ত করে লিখেছেন, 'আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে আমাকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রমাণ দিতে হলো, আমি বেঁচে আছি। আমার মৃতু্য নিয়ে এ ধরনের স্ট্যাটাস কখনো দিতে হবে ভাবিনি।'

এমন গুঞ্জন ছড়ানোর পেছনে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই বরেণ্য ব্যক্তিত্ব দায়ী করেন সোশ্যাল হ্যান্ডেলের কিছু মানুষকে। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় হানিফ সংকেত বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী এক শ্রেণির বিকৃত মানসিকতার মানুষ তাদের ভিউ ব্যবসা ও ফলোয়ার বাড়াবার প্রত্যাশায় মানুষের মৃতু্য নিয়ে এমন মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে অসামাজিক কাজ করছে। একজন সুস্থ মানুষকে মেরে ফেলার পেছনে এদের কী ধরনের মানসিকতা কাজ করে আমার বোধগম্য নয়। তারা কী একবারও চিন্তা করে না আমাদেরও পরিবার আছে, আত্মীয়স্বজন আছে, শুভাকাঙ্ক্ষী আছে? এ ধরনের সংবাদে তাদের মানসিক অবস্থা কী হতে পারে? আমি আপনাদের সবার দোয়া ও ভালোবাসায় সুস্থ আছি। ভালো আছি। আমার কোনো রকম কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি।'

হানিফ সংকেত জানান, ২৪ মে দিবাগত রাত নয়, এই গুঞ্জন ছড়ানো হয় দু'দিন ধরে। তিনি বলেন, 'গত দু'দিন ধরে আমি ও আমার পরিবার এই মৃতু্য গুজবের কারণে নিদারুণ মানসিক কষ্টে আছি। শত শত মানুষ যোগাযোগ করেছেন, এখনো করছেন। সুস্থতা কামনা করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শুধুমাত্র ভিউ, লাইক, শেয়ার পাওয়ার জন্য একজন মানুষকে এরা মেরে ফেলবে? এ কি ধরনের মানসিকতা? নাকি এদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে? এর আগেও বেশ কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মৃতু্যর আগেই মৃতু্যর গুজব ছড়িয়েছে একটি মহল। সময় এসেছে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। যেসব মাধ্যম এবং পেজ থেকে এ ধরনের সংবাদ আপলোড হচ্ছে, শেয়ার হচ্ছে তাদের আপনারা বুঝিয়ে দিন, না জেনে না শুনে নিশ্চিত না হয়ে কোনো কিছু শেয়ার করা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও।'

'আমার আকস্মিক মৃতু্যর গুজবে যারা কষ্ট পেয়েছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন সবার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আর যারা এ ধরনের গুজব ছড়িয়েছে তাদের প্রতি অন্তর থেকে ঘৃণা প্রকাশ করছি।' লেখায় তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে উলেস্নখ করেন 'ইতোমধ্যে আমি সাইবার ক্রাইম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা শিগগিরই ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। আর একটি অনুরোধ, গুজবে কখনো কান দেবেন না। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের দোয়া ও ভালোবাসাই আমার পাথেয়।'

মৃতু্যর ভুয়া খবরের দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ভক্তরা জানতে চান এখন কেমন আছেন বিনোদন অঙ্গনের তুমুল এই মহাতারকা? এ নিয়ে সোমবার যোগাযোগ করা হয় হানিফ সংকেতের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ফাগুন অডিও ভিশনে। প্রতিষ্ঠানটির প্রোগাম এক্সিকিউটিভ মামুন মাহমুদ বলেন, 'সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে ওনি আগের মতোই সুস্থ আছেন। কোনো ধরনের শারীরিক অসুস্থতাও নেই। পুরোপুরি ভালো আছেন। তিনি এখন দেশের বাইরে ইউএসে আছেন। ওনার মৃতু্য নিয়ে ফেসবুকে যা রটেছিল তা ছিল পুরোটাই গুজব। বিষয়টি পরে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে এমন বিভ্রান্ত খবর রটানো নিঃসন্দেহে অনৈতিক কাজ। এভাবে মানুষকে আতঙ্কের মাঝে ফেলার কোনো মানে হয় না।' মামুন জানান, আমেরিকার উদ্দেশ্যে ২৯ মে ঢাকা ছেড়েছেন হানিফ সংকেত। 'ইত্যাদি'র জন্য নয়, ব্যক্তিগত কাজের জন্যই সেখানে যাওয়া। সঠিক করে বলতে না পারলেও মাসখানেক পর হানিফ সংকেত দেশে ফিরবেন বলে জানান মামুন।

৩০ বছর ধরে চলে আসা 'ইত্যাদি'র মাধ্যমে হানিফ সংকেত সমাজের নানা প্রচলিত অসংগতির বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠ রাখেন। 'ইত্যাদি'র প্রতিটি পর্বে সমসাময়িক নিন্দিত ঘটনার বর্ণনা ও বিরোধিতা থাকে কিছুটা রম্য হলেও দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে। তাই বিবিসিসহ দেশের প্রতিটি জরিপেই দেখা গেছে, 'ইত্যাদি' দেশের সেরা টিভি অনুষ্ঠান এবং দেশের ৭৫ শতাংশ টিভি দর্শক এই অনুষ্ঠান দেখে থাকে।

দেশের তুমুল জনপ্রিয় এই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটি বছরে কয়েকবার প্রচারিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। প্রতি পর্বেই থাকে নতুন আয়োজন। সর্বশ্রেণির দর্শকের কাছে অনুষ্ঠানটি আকর্ষণীয় করে তুলতে নেপথ্যে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। ইত্যাদি টিমের অক্লান্ত পরিশ্রমে দর্শক পান সুন্দর একটি পর্ব। এ পর্বটি প্রচার হওয়ার পরদিন থেকেই শুরু হয় নতুন পর্বের কাজ। পুরো টিমকে সারা মাস ব্যস্ত থাকতে হয় ইত্যাদি নিয়ে। মামুন বলেন, 'স্যার প্রতিদিনই অফিস করেন। অফিসে আসেন সবার আগে, বের হনও সবার পরে। ইত্যাদির পরিবেশিত বিভিন্ন আইডিয়া তারই। আমরা তাকে কাজে সহযোগিতা করি। প্রতিটি সফল কাজের পেছনেই একটি ভালো টিমের ওয়ার্ক থাকে। ইত্যাদির টিম মেম্বার কিন্তু অনেক নয়, মাত্র কয়েকজন। আমরা সবাই মিলে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করি।'

নতুন পর্বের জন্য কাজ করছে 'ইত্যাদি'। মামুনের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন তিনি 'ইত্যাদি'র কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। বরাবরের মতো এবারও 'ইত্যাদি' আসছে নানা পসরা নিয়ে নতুন আয়োজনে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে