বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কুমার বিশ্বজিৎ এখনও সবুজ সতেজ

ম মাতিয়ার রাফায়েল
  ১৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

জননন্দিত সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। 'চিরসবুজ'খ্যাত এ শিল্পীর প্রকৃত বয়স কত আজও এক রহস্যের ধাঁধায় রয়ে গেছে। যদিও দেখা যায় জন্ম তার ১৯৫৯ সালের ১ জুন। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ শিল্পীর হাসিটিও যেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার অবিস্মরণীয় হাসির মতোই রহস্যময়। যে হাসিরও কোনো বয়স হয়নি। এমন নিষ্কলুষ হাসির বিশ্বজিৎ ইতোমধ্যে পেরিয়েছেন সংগীত ক্যারিয়ারের ৪০ বছর। যদিও তিনি ১৯৭৭ সালে মাত্র চৌদ্দ বছরে রেডিওতে গান গেয়ে তার সংগীত জীবন শুরু করেন। তবে গানে তার পেশাগতভাবে পদচারণা ১৯৮২ সাল থেকেই। ১৯৮৫ সালে আলাউদ্দিন আলীর সুর ও সংগীতে নূর হোসেন বলাইয়ের 'আমরা দু'জন দুটি শান্ত ছেলে' গানে প্রথম পেস্ন-ব্যাক করেন তিনি। এরপর অসংখ্য আধুনিক ও চলচ্চিত্রের গান গেয়ে শ্রোতাদের মাত করেছেন এ গায়ক। পেয়েছেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এখনো যার গাওয়া নতুন গানের প্রতি শ্রোতা-দর্শকের রয়েছে ব্যাকুল আগ্রহ ও প্রগাঢ় ভালোবাসা। এখনো স্টেজ শোতে সমান অনবদ্য। এখনো দর্শকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্টেজ শোগুলোতে তার। নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের গানেও একের পর এক হিট হতে থাকে।

সেই যে ৪০ বছর আগে তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে কাঁপন ধরানো 'তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে...' গানের শুরু- সেই কাঁপন আজও অমলিন তার গানে। গানটি বিটিভিতে আল মানসুর প্রযোজিত 'শিউলীমালা' অনুষ্ঠানে প্রথম প্রচার হয়েছিল। এরপরই অডিওতে ছড়িয়ে দেওয়া সেই মন মাতানো গানের তরঙ্গ আজও তার বয়সের সঙ্গে সমান মানানসই। একই কণ্ঠের জাদুতে জয় করে চলেছেন কোটি মানুষের হৃদয়। ৪০ বছর আগের সেই সুর আজও একই মমতায় প্রাণবন্ত হয়ে আছে তার কণ্ঠে। আজও প্রকাশ ঘটে তার কণ্ঠে প্রেম-রোমান্সের গান সমান আবেদনেই চির সবুজতায়।

সেই এক গানেই রাতারাতি তারকাখ্যাতি পাওয়া বিশ্বজিতের আরেক শ্রোতাপ্রিয় গান, 'চতুর্দোলাতে চড়ে দেখো ওই বধূ যায়...' দ্রম্নততম সময়ের মধ্যেই যশ লাভ করা এমন কয়টি শ্রোতাপ্রিয় গান তাকে এত জনপ্রিয় করে তোলে, পরবর্তী সময়ে আসা পশ্চিমবঙ্গের আরেক জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়ের (বর্তমান নাম কবির সুমন) গানও বন্ধ করে দিয়ে শ্রোতারা কুমার বিশ্বজিতের গান শুনতে থাকতো। অথবা দুজনের গানই পালা করে শুনতো। সেই সঙ্গে ছিল জগজিৎ সিং, কিশোর কুমার, কুমার শানু প্রমুখ কালজয়ী শিল্পীরা। এভাবেই এপার বাংলার এক সংগীতশিল্পীর সঙ্গে ওপার বাংলার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীদের সমান শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি তার গানের কথা ও কণ্ঠের জাদুকরী মাদকতায়। উত্তীর্ণ হয় তার গান কালজয়ী ক্লাসিকে। শুধু তাই নয়, এ দেশে অডিও পস্ন্যাটফর্মটিও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে বিশ্বজিতের গান শুনে শুনেই। গানে গানে গল্পচিত্র তুলে ধরার বিষয়টি ওপার বাংলার শিল্পীদের পর বাংলাদেশে কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠেই প্রথম স্বার্থকরূপে ধরা দেয় এবং এ ধারার রিদমিক গান জনপ্রিয় করে তুলতে বিশ্বজিত নিজেই নিজের তুলনা। 'যেখানেই সীমান্ত তোমার'- বিটিভিতে প্রচারিত যে গানটি তেমন সাড়া না পেলেও অডিওতে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সীমানা পেরনো জনপ্রিয়তা পায়। এ থেকেও বোঝা যায়, এ দেশে গানকে জনপ্রিয় করে তোলায় অডিওর ভূমিকা কী রকম অপরিসীম।

সেই অডিও শিল্পটি হারিয়ে যাওয়ায় এ শিল্পীর মনেও যেন কী একটা আর্তনাদ কেঁদে ওঠে : 'আমরাই প্রথম নন-ফিল্মিক গানে একটা নতুন ক্রেজ এনেছিলাম। সিনেমায় তো দৃশ্যায়নের ব্যাপার থাকে, কাহিনীচিত্র, নায়ক-নায়িকা থাকে। সেগুলো একধরনের মিউজিক ভিডিওই। কিন্তু আমাদের নন-ফিল্মিক ক্যাসেটের গানে কিচ্ছুই ছিল না। গান শুনেই মানুষ দৃশ্যায়ন করত। যার যার কল্পনা শক্তিতে চলে যেত। এ জন্যই বলছি মানুষ এত রোবটিক হয়ে গেছে, তার জন্মগত হৃদয়বৃত্তিক যে বৈশিষ্ট্য ছিল সেগুলো থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখন একান্নবর্তী পরিবার আছে? সিনেমা, নাটকে নেই- কারণ বাস্তবেই নেই। এখন পিতা-পুত্র এবং মাতা। শ্বাশুরিকেও রাখে না; মাকেও রাখে না।' বলেন বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে যায়যায়দিনকে, 'মা এবং তুমি রোজ বিকালে'র মতো কখনো ভুলে না যাওয়া অনেক কালজয়ী গানের এ শিল্পী। কিন্তু 'পুতুলের মতো করে সাজিয়ে' গানটি বর্তমান সময়ের আধুনিক স্বাধীনচেতা নারীদের মন কতটা সাড়া দিত- এমন দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এ শিল্পী বলেন, 'তারপরও প্রেম কিন্তু চিরকালই এক। প্রেমের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা চিরকালই এক থাকবে। 'তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে হৃদয়ের কুঠুরে রাখবো' গানটির সুরে যে ব্যঞ্জনা ও আবেদন রয়েছে তা শাশ্বত, তা চিরকালীন। তবে বর্তমানে আধুনিকতার নামে নারীকে যেভাবে সাজানো হচ্ছে তাকে আমি আধুনিকতা মনে করি না। আধুনিকতার নামে আমার মা'কে এই সাজাতে সাজাতে কোথায় নিয়ে যাবেন? 'হাফপ্যান্টে' নামিয়ে আনবেন? নাকি আরো অন্য কোথাও? এর নাম তো আধুনিকতা নয়। আধুনিকতা হচ্ছে চিত্তের পরিশুদ্ধি করা ও মানবিক হওয়া। এই আধুনিকতায় চিত্তের শুদ্ধি বা মানবিক হওয়া দূরের কথা বরং আমি দেখছি তা দূষিত আর অমানবিকই হচ্ছে। একসময় মানুষের মধ্যে হৃদয়ের যে শুদ্ধ জায়গাটা ছিল সেটা ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে।' যে অডিওতে তার গান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, জনপ্রিয়তা পেয়েছে- সেই শ্রোতারা কি আছে এমন কথায় চিরসবুজ এ শিল্পী তার সমগ্র সময়কেই চিরসবুজময় দেখাতে গিয়ে বলেন, 'আমি তো এখনো সমকালীন। আমার আবার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের শ্রোতা কি। ওই সময়ের শ্রোতা আর বর্তমানের শ্রোতায় কোনো ফারাক নেই। শ্রোতা বলতে তো তিনটা শ্রেণিই বুঝায়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং যারা দিন আনে দিন খায়- সেই নিম্নবিত্ত। এই তিন শ্রেণির শ্রোতা আগেও ছিল বর্তমানেও আছে। তবে প্রযুক্তিতে একটা পরিবর্তন আসায় এখন শ্রোতা বলতে কিছু নেই। এখন গান হয়ে গেছে দেখার বিষয়। শোনার নয়। ফলে এখন আগের সেই শ্রোতাও নেই। এই যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 'তুমি কেমন করে গান করো যে গুণী, অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি'- গানের কল্পনায় ডুবে যাওয়া সেই শ্রোতা কি এখন আছে? যে কালে শ্রোতাদের হয়তো ইহজীবনেও গায়ককে দেখার সুযোগ হয়নি এই গানের কথা সেই সময়ের। এখন গানেই দেখানো হচ্ছে গায়কের সঙ্গে আপনিও তার গানের কথা ও সুরের সঙ্গে কখন কোনো কাঞ্চন জঙ্ঘায় চলে যাচ্ছেন, কিংবা আরও দূরে কোন মেঘমালার ভেতরে... এমন সব ইমেজের কম্পোজিশন। এখন আপনাকে বাধ্য করছে এই কম্পোজিশনমতো কল্পনা করতে। নিজের স্বাধীনমতো কল্পনা করবেন সেই সুযোগই নেই এখনকার ভিডিওতে। অথচ একসময় শ্রোতারা গায়কের আড়ালে থেকেও তার গানের ব্যঞ্জনার সঙ্গে নিজের কল্পনার স্বাধীনতা মেশাতো। এখন সে রকম স্বাধীনতা আছে? ইউটিউব আপনাকে বাধ্য করছে এমন কল্পনা করতে- যার ইমাজিনারি তারাই তৈরি করছে। আর আপনাকেও সেভাবেই কল্পনা করতে হচ্ছে। সুতরাং এখন আগের সেই স্বাধীন শ্রোতা নেই!' এতটা বছর পার করেও কী করে তিনি আজও সেই অমলিন চিরসবুজ হয়ে আছেন এর রহস্য জানতে চাইলে সহাস্যে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, 'এই চিরসবুজ আপনিও থাকতে পারবেন (কিঞ্চিৎ হাসি)। মনকে সুন্দর রাখুন, মনে কোনো দাগ লাগানো থেকে বিরত থাকুন, আপনিও চিরসবুজ থাকবেন। আমি কখনোই জ্ঞানত কারো মনে কষ্ট দেওয়ার মতো কাজ করি না। কারো সঙ্গে প্রতারণামূলক কাজ করি না। মনকে সবসময়ই শুদ্ধ রাখতে চেষ্টা করি।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে