পরিশ্রম ও মেধার ঘাটতি থাকলে শিল্পী হওয়া যায় না

বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের। অসংখ্য মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দ্যুতি ছড়িয়েছেন। শুধু অভিনেতাই নন, একজন নিদের্শক ও লেখকও তিনি। বতর্মানে টেলিভিশন নাটক থেকে দূরে থাকলেও এখনো মঞ্চে সক্রিয়। অভিনয় ও সমসাময়িক নানা বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেনÑ মাসুদুর রহমান

প্রকাশ | ১২ জুলাই ২০১৮, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
আলী যাকের
আপনার বতর্মান ব্যস্ততা সম্পকের্ কিছু বলুন- হ নিয়মিত ব্যবসায় সময় দিচ্ছি। এ ছাড়া লেখালেখির পাশাপাশি মঞ্চ নাটকেও কাজ করছি। অচিরেই আমাদের নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘গ্যালিলিও’ নাটকের প্রদশর্ন হবে। এখানে আমি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছি। এবারে নাটকটির সমন্বয় করছেন পান্থ শাহরিয়ার। আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এর প্রদশর্নী হবে শিল্পকলায়। প্রদশর্নী আগস্টে হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু শোকের মাস হওয়ায় আমরা তা করছি না। লেখালেখির খবর কী? হ লেখালেখির অভ্যাসটা তো দীঘর্ দিনের। এক কথায় বলতে, সেই বাল্যকাল থেকেই লিখে আসছি। বতর্মানে আমি আত্মজীবনী লিখছি। এটি আমার আত্মজীবনীর দ্বিতীয় বই। নাম রেখেছি ‘মধ্যাহ্ন-অপরাহ্ন’। এটি আগামী বইমেলায় প্রকাশের ইচ্ছে আছে। মঞ্চে নিয়মিত হলেও ছোটপদার্য় নেই কেন? হ শরীর স্বাস্থ্য যতদিন ভালো থাকবে, তত দিনই আমার মঞ্চ নাটকে অভিনয় করার ইচ্ছা আছে। মঞ্চে আমি সব ধরনের নাটকেই অভিনয় করে যেতে চাই। আর টেলিভিশন নাটকের প্রতি তেমন কোনো টান নেই আমার। এখন আগের মতো সে রকম ভালো গল্প পাওয়া যায় না। বতর্মানে টেলিভিশন নাটকের মান হারিয়ে গেছে। আমার কাছে টেলিভিশন নাটকে কাজ করা মানে সময় অপচয় মনে হয়। যতটুকু মনে পড়ে সবের্শষ তিন-চার বছর আগে ছোটপদার্য় কাজ করেছিলাম । টিভি নাটক দেখা হয়? হ টিভি নাটক খুব কমই দেখি। গেল ঈদের একটি নাটকও দেখিনি। আমি ওই সময়টাতে ঢাকার বাইরে ছিলাম। ঢাকায় থাকলে হয়তো দু-একটি নাটক দেখা হতো। বলা যেত কেমন হয়েছে এবারের ঈদের নাটক। বতর্মান টেলিভিশন নাটকের মান নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? হ এখন আর আগের মতো শুধু বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) নেই। আমাদের দেশে এখন অনেক টিভি চ্যানেল। প্রচুর নাটক প্রচার হচ্ছে। এই অসংখ্য নাটকের মধ্যে ভালো-মন্দ দুটিই আছে। তবে ছোট পদার্য় মেধা অপযার্প্ততা রয়েছে। আসলে শিক্ষার অভাব হলে যা হয়। বিশ্ব সংস্কৃতি যোগাযোগে শিল্প ও সংস্কৃতি উন্নয়নের যে শিক্ষার দরকার, তা এখন নেই। সঠিক শিক্ষা না থাকলে কোনো কিছুতেই সাফল্য আসে না। শুধু নাটক নয়, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সব বিষয়ে প্রচুর পড়তে হবে। মঞ্চ নাটকের অবস্থা কেমন? হ আমাদের মঞ্চ নাটকগুলোর মান অনেক ভালো। বিশ্ব মঞ্চনাটকে আমরা সুনাম অজর্ন করছি। তবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের একটু সমস্যাও আছে। বিশেষ করে কারিগরি দিকটায়। উন্নত দেশের কারিগরি আর আমাদের দেশের কারিগরির মধ্যে অনেক পাথর্ক্য। এ দিকটায় আমরা পিছিয়ে থাকলেও অন্য দিকে পিছিয়ে নেই। অনেক নাটকের দল তৈরি হচ্ছে, নতুন নতুন নাটক হচ্ছে, নতুনরা আসছে। সে হিসেবে মঞ্চ নাটকের অবস্থা ভালো। তবে কিছু প্রতিক‚লতাও আছে। টেলিভিশন ও মঞ্চ নাটকের মূল পাথর্ক্য কোথায়? হ টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে আথির্ক বিষয়টি জড়িত। প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী ও কলাকুশলী কেউই এর বাইরে নয়। টেলিভিশন নাটকের পেছনে একটি ব্যবসায়িক চিন্তা থাকে। এখানে জড়িতরা অনেকেই এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর মাধ্যমে নিজেকে অন্যভাবে উপস্থাপনও করা হয়। কিন্তু মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রটা একটু ভিন্ন। এখানে আথির্ক বিয়টি একেবারেই নগন্য। পেশাদার মঞ্চকমীর্ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরা অত্যন্ত কঠিন। মঞ্চ ও টেলিভিশনের শুরুটা? হ ১৯৭২ সালে মনির চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের মাধ্যমে আমার মঞ্চের কাজ শুরু। এর পরপরই মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রেঁা’ তেও কাজ করি। তারপরে তো অনেক নাটকে কাজ করেছি। অনেক নাটকে নিদের্শনাও দিয়েছি। মঞ্চে প্রথম নিদের্শনা দিয়েছিলাম ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকের। এটা প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রæয়ারি। ওই ১৯৭২ সালেই টেলিভিশনে কাজ করি। টেলিভিশনের প্রথম নাটকও ‘কবর’। তখন তো এক বেলায় কাজ করতাম মঞ্চে আরেক বেলায় কাজ করতে হতো টেলিভিশনে। অনেক একক ও ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছি। তখনকার টেলিভিশন নাটকের গল্প ও নিমার্ণশৈলী ছিল চমৎকার। কাজ করেও অনেক ভালো লাগত। পরিবেশটাও ছিল মনের মতো, ভালোলাগার। এখন টেলিভিশন নাটকের সেই পরিবেশ নেই। আপনি তো চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন? হ হ্যঁা, হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। তানভীর মোকাম্মেলের ‘রাবেয়া’র পর আর কোনো চলচ্চিত্রে কাজ করিনি। ওটাই শেষ, আর হয়তো হবেও না। ‘নদীর নাম মধুমতি’ কিংবা ‘রাবেয়া’র মতো ছবিগুলোতে কাজ করেছি ঠিক তবে, কোনো বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে কাজ করা হয়নি। অভিনয়ে আসার গল্পটা জানতে চাই? হ আমার জন্ম চট্টগ্রামে। আমরা চার ভাইবোন ছিলাম। বছরে একবার মার সঙ্গে কলকাতায় যেতাম মামার বাড়ি। সেখানে অনেক মঞ্চ নাটক হতো। খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে সেসব নাটক দেখতে যেতাম। ওই আমাকে উৎসাহিত করত নাটক দেখতে। ইডিপাস, রক্তকরবী, চার অধ্যায়, রাজাসহ ওই সময়ের প্রায় সবই আমি দেখেছি। আর উৎপল দত্তের নাটক দেখতামÑ অঙ্গার, কল্লোল এগুলো তো সাংঘাতিক লেগেছিল, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেছি। তখন আমি স্কুলজীবন শেষ করেছি মাত্র। অভিনয় দেখতে দেখতে অভিনয়ের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়। পরে আমরা সমবয়সী কয়েকজন মিলে পাড়ায় নাটকের কাজ শুরু করি। সেখান থেকেই শুরু। এর পর তো দেশে ফিরে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে গেলাম নাটকে। একজন প্রকৃত শিল্পীর প্রধান গুণ কোনটি বলে মনে হয়? হ পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়ে একজন প্রকৃত শিল্পী তৈরি হয়। এর একটির ঘাটতি থাকলেও শিল্পী হওয়া যায় না। আমরা এখন আপাতদৃষ্টিতে গা ভাসিয়ে দিই। সহজে সাফল্য পাওয়ার চিন্তা থেকে দূরে থাকতে হবে। জীবনের এই পযাের্য় এসে নিজেকে নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী? হ আমি খুব সৌভাগ্যবান। আমি যা করতে চেয়েছি, তা করতে পেরেছি এবং আমার যতটুকু স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব, তার সবটাই পেয়েছি। আমার কোনো ধরনের দুঃখবোধ নাই। আমি অত্যন্ত সুখী একজন মানুষ।