শোনা নয় গান এখন দেখা হয়

প্রকাশ | ১০ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

মাসুদুর রহমান
মিউজিক ভিডিওতে তাপস ও সানি লিওন
‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুশির্দী গাইতাম হায়রে...’ শাহ আব্দুল করীমের এই গান যেন এখন আর মনকে দোলা দেয় না, পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যায় না। বরং লম্বা একটা দীঘর্শ্বাস বের হয় শ্রোতাদের মন থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছু। পরিবেশের পাশাপাশি বদলে গেছে গান প্রকাশের ধরন এবং মাধ্যম। এই তো কদিন আগেই সিনিয়র ও জনপ্রিয় শিল্পীরা গান প্রকাশের যেন অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। যেখানে সাবিনা ইয়াসমিনের মতো লিজেন্ড তারকার গান প্রকাশ করতে আগ্রহ দেখায়নি কোনো প্রতিষ্ঠান, সেখানে এখন যে কেউ শিল্পী হয়ে ‘বাজার মাত’ করতে পারছেন। সুর, তাল, লয়, এমনকি নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যাচ্ছেতাই গান তৈরি করছেন। তা ছাড়া গান এখন শোনার নয়, দেখার বিষয় হয়ে দঁাড়িয়েছে। আর ইউটিউবই যেন একমাত্র বাজার হয়ে উঠেছে চলমান সময়ের শিল্পী ও কলাকুশলীদের কাছে। মানহীন, কুরুচিপূণর্ সস্তা কথাকে উপজীব্য করেই তৈরি হচ্ছে গান, নিমির্ত হচ্ছে মিউজিক ভিডিও। সিনেমার গানেও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। অশ্লীল কথার গানের কারণে গেল বছর মুক্তির আগেই সমালোচনায় আসে জাজ মাল্টিমিডিয়ার বহুল আলোচিত ছবি ‘দহন’। তোপের মুখে পড়ে অবশেষে ‘হিসু করে’ শিরোনামের গানটি সংশোধন করতে বাধ্য হন ছবির পরিচালক। তার আগের বছর ২০১৭ সালে একই প্রতিষ্ঠানের ‘বস টু’ সিনেমায় আইটেম গানে ধমীর্য় অনুভ‚তিতে আঘাতের অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি আদালত পযর্ন্ত গড়ায়। আমাদের গানের গৌরবের ঐতিহ্য থাকলেও বতর্মানে মানহীন গানের কারণে এভাবে ক্রমেই তার জলুস হারিয়ে যাচ্ছে। গান সাধনার বিষয় হলেও তা সহজ হয়ে যাচ্ছে। এক সময় গান প্রকাশ ছিল কষ্টসাধ্য। নামিদামি শিল্পীরাও তাদের অ্যালবামের জন্য দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতেন। বিশেষ দিবস উপলক্ষে গানের অডিও বাজার ছিল চাঙ্গা। অডিওর দোকানে ক্রেতারা ভিড় করতেন প্রিয় শিল্পীর গানের অ্যালবাম কিনতে। মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত সেই গানের কথা ও সুর। কালজয়ী হয়ে যুগের পর যুগ টিকে থাকত সেইসব গান। কিন্তু এখন সেই স্বণার্লী সময় হারিয়ে গেছে। অডিও বাজারে ধস নেমেছে অনেক আগেই। এখন আর ৮-১০টি গান নিয়ে সিডি কিংবা ক্যাসেটে গান প্রকাশ হয় না। দোকানে দোকানে বাজে না নতুন অ্যালবামের সেইসব হৃদয়ছেঁায়া গান। আগে মানসম্পন্ন গানের কথা, সুর, সংগীত ও গাওয়ার ধরনের মাধ্যমে গান তৈরি হতো। যার ফলে সে গানগুলো কালজয়ী হয়ে যুগের পর যুগ শ্রোতাদের মুখে মুখে থাকত। আর এখন একটি গানের স্থায়িত্ব এক বছরও হচ্ছে না। একজন শিল্পীর একটি গান প্রকাশের পর আরেকটি প্রকাশ হলেই আগের গানটি কেউ মনে রাখছে না। এর মূল কারণ হলো ভালো কথা-সুরের অভাব, রাতারাতি গান হিট করার প্রয়াস, এমনটাই মনে করছেন সংগীতবোদ্ধারা। এমন সস্তা কথা-সুরের গানের প্রভাবে হাতে গোনা ভালো গানগুলো জায়গা করে নিতে পারছে না। যারা মেধাবী তারা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে প্রচারণায় নামতে নারাজ। আর এর ফলে বতর্মানে ভয়ঙ্কর অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে সংগীতাঙ্গন। এসব নিয়ে সিনিয়র শিল্পী, সংগঠন, অডিও কোম্পানি বা সরকারি কোনো উদ্যোগ কিংবা নজরদারি নেই। কেবল আলোচনা ও বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে বিষয়টি। এ বিষয়ে বরেণ্য সংগীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, আসলে দিন দিন যে গানের মান খারাপ হচ্ছে এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এখন মন থেকে ভালোবেসে গান করেন ক’জন তা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। সেটার সংখ্যা হবে হাতে গোনা। আর সস্তা কথা-সুরের গানই এখন বেশি শুনতে পাই। বিশেষ করে ইউটিউব আসার পর এই প্রবণতা আরও বেড়ে গেছে। সংগীতশিল্পী মনির খান বলেন, অনেক নতুনরাই মানহীন গানের মিউজিক ভিডিও করে নিজেদের প্রচারের চেষ্টা করছে। গান আসলে দেখার নয়, শোনার জিনিস। কাগজের ফুল সৌরভ ছড়ায় না কিন্তু আল্লাহর সৃষ্টি একটি ফুল চারদিকে সুভাষ ছড়ায়। অনেক নতুনরাই কাগজের ফুলের মতো বৃথা সুভাষ ছড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত। এজন্যই শ্রোতারা এখনকার গানে প্রাণ খুঁজে পান না। আগের মতো এখনকার গানে স্থায়িত্ব নেই। সংগীতের আরেক শিল্পী রবি চৌধুরী বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে অডিও ক্যাসেট কিংবা সিডির সময়টাকে মিস করি। কারণ সে সময় রমরমা অবস্থা ছিল। উৎসবগুলোতে বিভিন্ন শিল্পীর ক্যাসেট কিংবা সিডি বের হতো। সেই সময়টা এখন নেই। পরিবতর্ন হয়েছে। সময়ের সঙ্গে প্রতিটি বিষয়ে পরিবতর্ন আসবে এটাই স্বাভাবিক। ভালো গান মিউজিক ভিডিও ছাড়া মানুষ শোনেন এটাও ঠিক। তবে, ভালো গানের মিউজিক ভিডিও করা যেতে পারে। কিন্তু যত্রতত্র গানের ভিড়ে ভালো গানের সংখ্যা খুবই কম।