স্বতন্ত্র অভিনয়ের দিশারি

প্রকাশ | ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
ফজলুর রহমান বাবু
তিন দশক আগে সেই ১৯৯১ সালে বিটিভিতে অভিনয়ের শুরু তার। তখন থেকেই অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ড্রয়িং রুমের দর্শকের নজরে পড়েছিলেন। তিনি ফজলুর রহমান বাবু। বিটিভিতে যে ক'জন মুষ্টিমেয় অভিনেতা অভিনয় দিয়ে দর্শকের মন জয় করেছেন, ফজলুর রহমান বাবু তাদের অন্যতম। এ দেশের ছোটপর্দায় যারা অভিনয়ে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বাবু প্রথম কাতারেই থাকবেন। থাকবেনই না কেন, এ মাধ্যমে তার যে একটা ভালো বুনিয়াদী শিক্ষাও আছে। সব অভিনয়ের আঁতুরঘর বলে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ যে মঞ্চ, সেখান থেকেই যে তার বেড়ে ওঠা! অভিনয়ে হাতেখড়ি তার একেবারে তৃণমূলের মঞ্চ থেকেই। ১৯৭৮ সালে ফরিদপুরে 'বৈশাখী নাট্য গোষ্ঠীতে' যোগদানের মাধ্যমে তার অভিনয় জীবনের শুরু। একই বছর, বাবু প্রথমবারের মতো জাতীয় নাট্য উৎসবে অভিনয় পরিবেশন করেন। এরপর ১৯৮৩ সালে নাট্যগুরু মামুনুর রশীদের হাত ধরে 'আরণ্যক নাটদল' এ যোগদান করে পুরাদস্তুর মঞ্চ অভিনয় শিল্পী হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ অভিনয়ে পরিপক্ব হয়ে উঠতে বাবুকে খুব বেশি সময় ক্ষেপণ করতে হয়নি। মঞ্চে তার অভিনীত উলেস্নখযোগ্য নাটক হলো 'নঙ্কার পালা', 'পাথার' এবং 'ময়ূূর সিংহাসন'। সহজাত প্র্রতিভাগুণেই শুরু থেকেই পাদপ্রদীপের আলোয় দীপ্তমান ছিলেন ফজলুর রহমান বাবু। মঞ্চে যেমন তার অভিনয় দিয়ে দর্শককে সম্মোহিত করতে সক্ষম হয়েছেন ছোটপর্দাতেও সেটা বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। একপর্যায়ে ছোটপর্দায় নিজেকে এতটাই অপরিহার্য অভিনয় শিল্পী হিসেবে প্রমাণ করেন যে, তখন বিটিভি নির্মাতারা তার বিকল্পই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যে কারণে তাকে ছোটপর্দায় মাসে ২৫ দিনই ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে বাধ্য হয়েই মঞ্চ থেকে সরে আসতে হয় তাকে সময়ের অভাবে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকের চাকরিটাও ছাড়তে হয়। ২০০০ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে টেলিভিশন এবং থিয়েটারে কাজ করে গেলেও ব্যস্ততার কারণে চাকরি ও মঞ্চ দুটোই ছাড়তে হয়। ২০০০ এবং ২০০১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বাবু প্রথমবারের মতো আব্দুলস্নাহ আল মামুনের সঙ্গে কাজ করেন, মঞ্চ নাটক বিহঙ্গ নাটকে। ফজলুর রহমান বাবু একদিকে যেমন হাস্যরসাত্মক অভিনয়ে দর্শকপ্রিয় আরেক দিকে রাশভারী বা গম্ভীর চরিত্রেও অনবদ্য। শুধু অভিনয় দিয়েই নয় সঙ্গীত দিয়েও নিজের প্রতিভার জানান দিতে পেরেছেন তিনি। তার কণ্ঠে বহু গানই শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। 'মনপুরা' সিনেমায় দুটি গান গেয়ে তো তিনি শ্রোতাদের কাছে অভিনয়ের অতিরিক্ত একজন গানের শিল্পীও হয়ে আছেন। তিনি যখন থেকে বড়পর্দায় পা রাখেন তখন থেকেই তার প্রতিভাকে একে একে আরও নতুন উচ্চতায় মেলে ধরতে থাকেন। এখানেও তার একের পর এক অভিনয়ে মুগ্ধ হতে থাকেন দর্শক। বলা যায় চলচ্চিত্রে পদার্পণ থেকে এখানেই যেন তিনি তার সর্বোচ্চটা দিতে পেরেছেন এবং সেটা অব্যাহতও রেখেছেন। তাই তো আবারও ২০২১ সালের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করতে যাচ্ছেন। এ নিয়ে পরপর তিনবার অর্থাৎ হ্যাট্রিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করতে যাচ্ছেন। যেটা গোটা ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই কম দেখা গেছে। রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত পরিচালিত 'নোনাজলের কাব্য' সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এবারও তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাচ্ছেন। যা সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে প্রকাশ করা হয়েছে। ফজলুর রহমান বাবু নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে যেমন দর্শকের বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন চলচ্চিত্রেও সে ধারা অব্যাহত রেখেছেন। গোলাম রব্বানী বিপস্নবের 'স্বপ্ন ডানায়', 'বৃত্তের বাইরে', এনামূল করিম নির্ঝরের 'আহা' ও গিয়াস উদ্দিন সেলিমের 'মনপুরায়' অভিনয়ের কথা কি সহজে ভোলা যায়? 'আহা' সিনেমার সেই কাজের লোক, সেই গুপ্তঘাতক কিংবা 'মনপুরা' সিনেমার নায়িকার বাবা। নদীর জেলে- যার মাছ শিকার করে সংসার চলে। তখন বাবুকে চেনা যায় না। যেন এ বাবু নয়, সমুদ্রগামী কোনো নদীর অপরিচিত জেলে। তবে যে দুইটি গুণের কথা না বললেই নয়- সেটা হচ্ছে শঙ্খনাদ ও অজ্ঞাতনামা। শঙ্খনাদ চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রমধর্মী অভিনয় করেছেন বাবু। ওই চলচ্চিত্রে তার চরিত্র ছিল কাপড় চুরি করা। রাতের আঁধারে কবর খুঁড়ে লাশের পরনের কাফনের কাপড় চুরি করা। এ কাপড় চুরি করে বিক্রি করতেন। এই ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রে অভিনয়ের কারণে ২০০৪ সালে সেরা পাঁচ চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। বাবু এখন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন তাতে বোঝাই যাচ্ছে ঢাকাই সিনেমাকে তার দেওয়ার আরও অনেক কিছু আছে। তার সামর্থ্যের পরিমাণ অনেক, তার আরও অনেক বিচিত্র চরিত্রে বিচিত্র অভিনয় করার ক্ষমতা আছে। এখন নির্মাতারা যদি তাকে আরও ভালো করে বোঝার চেষ্টা করেন তাহলেই হয়। আজকে ঢাকাই সিনেমা হুমায়ূন ফরীদি নেই, কিন্তু ফজলুর রহমান বাবু আছেন। হুমায়ূন ফরীদিও ছোটপর্দা থেকে বড়পর্দায় এসেছিলেন। চিনিয়ে ছিলেন নিজের বহুমুখী প্রতিভার জাত। এখন বাবু তার স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত অভিনয় দিয়ে একের পর এক যে সাফল্যে ধরা দিচ্ছেন তিনিও সেটাকে আরও অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবেন- সেটাই এখন প্রধান চাওয়া।