প্রাণের টানেই মঞ্চে ফিরছেন সিনিয়র তারকারা

বেশিরভাগ আলোকিত তারকা এবং বরেণ্য অভিনয় শিল্পীর শুরুটা হয় মঞ্চ দিয়ে। এখন যারা টিভি ও চলচ্চিত্রের পদার্ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের প্রায় সবারই মূল শেকড় মঞ্চ। নানা ব্যস্ততায় মঞ্চ থেকে দূরে থাকলেও তাদের মন পড়ে থাকে মঞ্চেই। মঞ্চ তাদের ঠিকই টানে। তাই তো প্রাণের টানেই আবার মঞ্চে ফিরছেন সিনিয়র অভিনয় শিল্পীরা। লিখেছেনÑ মাসুদুর রহমান

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ঢাকায় মঞ্চের সাড়া জাগানো নাটক ‘গ্যালিলিও’। বাটর্ল্ট ব্রেখটের ‘দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলি’ অবলম্বনে এ নাটকটির অনুবাদ করেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। ১৯৮৮ সালে প্রথম যখন নাটকটি মঞ্চে এসেছিল, তখন এর নিদের্শক ছিলেন মঞ্চনাটকের খ্যাতিমান নিদের্শক ও অভিনেতা আতাউর রহমান। ১৯৯৮ সালে নাটকটির প্রদশর্নী বন্ধ হয়ে যায়। ২০ বছর পর গত বছরের অক্টোবরে নাটকটি আবার মঞ্চে আনেন নাগরিক সম্প্রদায়। নতুন করে নিদের্শনা দেন পান্থ শাহরিয়ার। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা আলী যাকের। পোপ, অধ্যক্ষ ও বিচারপতি এই তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও দীঘর্ ২০ বছর পর মঞ্চে অভিনয় করেন এ বরেণ্য অভিনেতা । নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এ নাটকটি নতুন করে মঞ্চে প্রদশের্নর পর দশের্কর মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। আলী যাকের ও নূরের অভিনয়ে আলোড়িত হয়ে ওঠে ঢাকার মঞ্চ। পুরনো অভিনয় শিল্পীদের মধ্যে আরও ছিলেন কাওসার চৌধুরী, আবদুর রশিদ ও ফারুক আহমেদ। নাটকটি নিয়ে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, প্রায় ২০ বছর পর এই নাটকের মাধ্যমে আবার মঞ্চে ফেরা। অভিনয় সবসময়ই টানলেও রাজনৈতিক ব্যস্ততায় অভিনয় করা হয়ে ওঠে না। এখন থেকে নিয়মিত নাটকে অভিনয় করার চেষ্টা করবেন বলেও জানান তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় নাটকটি আবার মঞ্চে ওঠে গত ২০ জানুয়ারি। দেশের অন্যতম সেরা নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত অভিনেত্রী সুবণার্ মুস্তাফা। দলটির হয়ে একাধিক নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি অজর্ন করেছেন। সেলিম আল দীনের লেখা ‘যৈবতী কন্যার মন’ নাটকের পরী চরিত্রে সুবণার্র অভিনয় এখনো দশর্কদের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এ ছাড়া শকুন্তলা’, কসাই, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হন সুবণার্ মুস্তাফা। নব্বই দশকের পর থেকে তিনি আর মঞ্চে অভিনয় করেননি। ব্যস্ত হয়ে পড়েন টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে। দীঘর্ ২৫ বছর পর গত বছরে মঞ্চে আবার অভিনয় করেন সুবণার্। তবে বাংলাদেশে নয়, কানাডার টরন্টোর মঞ্চে তিনি অভিনয় করছেন। গত ২৫ আগস্ট টরন্টোর প্যাভিলিয়ন মঞ্চে বদরুল আনাম সৌদ রচিত ও নিদেির্শত ‘একটি কাল্পনিক সত্যি কাহিনী’ নাটকের মঞ্চায়ন হয়। নাটকের প্রধান তিনটি চরিত্র। রেবেকা, অপণার্ ও দেবদূত। অভিনয় করেছেন সুবণার্ মুস্তাফা, চিত্রলেখা গুহ ও আহমেদ হোসেন। নাটকটির শিল্প নিদের্শক হিসেবে কাজ করেছেন উত্তম গুহ। চল্লিশ মিনিটের এই নাটকটি উপভোগ করেন মিলনায়তন ভতির্ দশর্ক। দশের্কর প্রতিক্রিয়ায় মুগ্ধ হয়েছেন অভিনেত্রী সুবণার্ মুস্তাফা ও চিত্রলেখা গুহ। এদিকে গত বছরের অক্টোবরে ফের মঞ্চে দেখা মেলে তারকা অভিনয় শিল্পী অপি করিমের। অভিনয় করেন ‘ডিয়ার লায়ার’ নামক মঞ্চ নাটকে। এই নাটকে অপি করিম হাজির হয়েছিলেন ব্রিটিশ অভিনেত্রী ‘প্যাট্রিক ক্যাম্পবেল স্টেলা’ হয়ে। তার সঙ্গে ‘জজর্ বানার্ডর্ শ’ হিসেবে দেখা যায় মঞ্চসারথী আতাউর রহমানকে। তৃতীয়বারের মতো আতাউর রহমান ও অপি করিম মঞ্চ ভাগাভাগি করেন। এর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী এবং সৈয়দ শামসুল হকের অপেক্ষমাণ নাটকে অভিনয় করেছেন তারা। অপি করিম বলেন, নিজের দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বাইরে প্রথম অন্য কোনো দলে অভিনয়। ১৮ অক্টোবর নাট্যম রেপাটির্রর প্রযোজনায় নাটকটি মঞ্চায়ন হয়। মাকির্ন লেখক জেরোম টিমোথি কিল্টির মূল লেখা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। নিদের্শনা দিয়েছেন আইরিন পারভিন লোপা। নাটকটি ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের। ঢাকার মঞ্চে আবার প্রদশর্নী হয় আরণ্যকের আলোচিত নাটক ‘ইবলিশ’। এই নাটকের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮১ সালে। মামুনুর রশীদেও লেখা ও নিদের্শনায় দেশ-বিদেশের মঞ্চে নাটকটির শতাধিক প্রদশর্নী হয়েছে। দীঘির্দন বন্ধ ছিল এই নাটকের প্রদশর্নী। যদিও নাটকটির একটি বিশেষ প্রদশর্নী হয়েছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে এ নাট্যদলের ৪৫ বছর পূতির্ উপলক্ষে আয়োজিত আন্তজাির্তক নাট্য উৎসবে। গত ৩০ অক্টোবর মঞ্চায়িত হয় ইবলিশ। পুরনো নাটকের এই প্রত্যাবতর্ন নিয়ে আরণ্যকের কমীর্রা বেশ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। নিদের্শক মামুনুর রশীদসহ মঞ্চে দেখা মেলে ফজলুর রহমান বাবু, আজিজুল হাকিম, শাহ আলম দুলাল, ফয়েজ জহির, মোমেনা চৌধুরী, আমিন আজাদ, রুবলী চৌধুরীসহ নবীন-প্রবীণসহ অনেক শিল্পীর। আজিজুল হাকিম বললেন, ‘ছাত্রজীবনে ইবলিশ করেছিলাম। এই নাটক নিয়ে আমরা আরণ্যকের কমীর্রা দিনের পর দিন একসঙ্গে কাটিয়ে দিতাম। পুরনো সেই পরিবেশ ফিরে পাওয়া সত্যিই ভালো লাগার। ফজলুর রহমান বাবু বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসছে। আরণ্যক আমার ঘর, আমার জন্মস্থান। যতই নাটক-সিনেমায় অভিনয় করি না কেন, মঞ্চকে মনে হয় আমার জায়গা।’ আরণ্যক নাট্যদলের নাটক ‘সংক্রান্তি’। ২০০১ সালের ৩১ জুলাই নাটকটি প্রথম মঞ্চে আসে। এরপর নিয়মিত মঞ্চায়নে দশর্ক নন্দিত হয় নাটকটি। এর রচনা ও নিদের্শনা দিয়েছেন মামুনুর রশীদ। নাটকটির শতাধিক প্রদশনীর্ হলেও ছিলেন না অভিনেতা শামীম জামান। তার অভিনয় শুরু হয়েছিল আরণ্যকের মাধ্যমে। এ দলের হয়ে বেশ কিছু নাটকে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু এখন টেলিভিশন নাটকে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় মঞ্চে সময় দেয়ার সুযোগ হয় তার। দীঘর্ ছয় বছর পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ‘সংক্রান্তি’ নাটকের মাধ্যমে আবার মঞ্চে অভিনয় করেন শামীম জামান। তিনি বলেন, এখন টেলিভিশন নাটকে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় মঞ্চে নিয়মিত সময় দেয়ার সুযোগ হয় না। তবে দীঘর্ ছয় বছর পর গত বছরে ‘সংক্রান্তি’ নাটকে কাজ করার সুযোগ হয়। একইভাবে মঞ্চে অভিনয় করে টিভি নাটকের ব্যস্ত অভিনেতা আ খ ম হাসান। টিভি নাটকের ব্যস্ত অভিনেত্রী তানভীন সুইটি অনিয়মিত হলেও কাজ করছেন মঞ্চে। ‘থিয়েটার বেইলী রোডে’র হয়ে নিয়মিত ‘মুক্ত’ নাটকে অভিনয় করছেন তিনি। ত্রপা মজুমদারের নিদের্শনায় এ নাটকের সবের্শষ মঞ্চায়ন হয়েছে গত ১৮ জানুয়ারি। গত মঙ্গলবার শিল্পকলায় মঞ্চস্থ হয় থিয়েটারের (নাটক সরণি) নাটক ‘দ্রৌপদী পরম্পরা’। এতে প্রথমবারের মতো মঞ্চে অভিনয় করেন মুনিয়া ইসলাম। তিনি এর আগে টিভি নাটক গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ছবি ‘স্বপ্নজাল’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। মঞ্চ নাটকে টিভি পদার্র অভিনয় শিল্পীদের ফেরা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল নাট্যব্যক্তিত্ব ড. ইনামুল হকের কাছে। তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূরসহ বেশ কিছু অভিনয় শিল্পী সম্প্রতি মঞ্চে কাজ করেছেন। আসলে এদের অভিনয় শুরু হয়েছিল মঞ্চ দিয়েই। যৌবনের সময়টা তারা কাটিয়েছেন মঞ্চে। তাই তারা মঞ্চকে ভুলতে পারেন না। কমর্যগ্য কিংবা নানা কারণে পদার্য় কাজ করলেও তাদের তো শেকড় মঞ্চ। মঞ্চ তাদের মনের মধ্যে ঢুকে গেছে। তাই সুযোগ পেলে তারা মঞ্চে কাজ করতে চান। আমার নিজেরও ইচ্ছে হয় মঞ্চে অভিনয় করতে। কিন্তু এই বয়সে তা সম্ভব নয়। তবে আমি মঞ্চের সঙ্গে অন্যভাবে জড়িত। নিজের নাট্যদল ‘নারগরিক নাট্যসম্প্রদায়’ তত্ত¡াবধান করছি। অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেল, বতর্মানে টিভি ও চলচ্চিত্রের পরিবেশ ভালো না থাকায় মনের টানেই মঞ্চে ফিরছেন তারা। মঞ্চকেই তাদের ঘরবাড়ি বলে মনে করেন তারা।