আলোকিত নারী সুবর্ণা মুস্তাফা

সুবর্ণা মুস্তাফা। সংস্কৃতি অঙ্গনের দু্যতিময়, জ্যোতিময় একটি নাম। কেউ তাকে বলেন জীবন্ত কিংবদন্তি। কেউবা আবার বলেন, অনন্য এক দৃষ্টান্ত তিনি। অন্য একদল তাকে উপাধি দিয়েছেন 'তারকাদের তারকা'। যে যে নামেই ডাকুক না কেন, নিজের নামের সঙ্গে কোনো বাড়তি বিশেষণ যোগ করলে বিব্রতবোধ করেন তিনি। নিজেকে একজন সাদামাটা, অতি সাধারণ মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করেন এই অভিনেত্রী। প্রচার-প্রচারণাতেও বেশ আপত্তি তার। আর প্রচার বিমুখ মানুষের সুবিধা হলো খ্যাতি কিংবা সফলতা যেন এমনিতেই ধরা দেয় তাদের কাছে। কী টেলিভিশন, কী মঞ্চ, কী বড় পর্দা সর্বক্ষেত্রে তার বিচরণ আলোর দু্যতির মতো। তার এই বিচরণ কয়েক দশক ধরেই। সম্প্রতি তিনি একই সঙ্গে দুটি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। একটি একুশে পদক পাওয়া, অন্যটি মহিলা সংরক্ষিত আসনের এমপি হওয়া। আগামীকাল ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। এ উপলক্ষে তারার মেলার মুখোমুখি হয়েছিলেন আলোকিত এই তারকা। বলেছেন, তার সাম্প্রতিক কর্মব্যস্ততা ও সফলতার গল্প।

প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

জাহাঙ্গীর বিপস্নব-
সুবর্ণা মুস্তাফা
গত বছর দিয়েই শুরু করা যাক। গত ডিসেম্বরে ৫৯ বছরে পা দিয়েছেন সুবর্ণা মুস্তাফা। কিন্তু এই বয়সেও যে তিনি চিরসবুজ, চির সতেজ- গত বছরে তিনি আবারও প্রমাণ করে দিয়েছেন। বেশ কিছু কাজে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে গত বছর জুড়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বরেণ্য এ অভিনেত্রী। দেশের অন্যতম সেরা নাট্যদল ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত তিনি। সেলিম আল দীনের লেখা 'যৈবতী কন্যার মন' নাটকের পরী চরিত্রে সুবর্ণার অভিনয় এখনও দর্শকদের হৃদয়ে গেঁথে আছেন। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর গত বছর মঞ্চে অভিনয় করলেন সুবর্ণা। গত ২৫ আগস্ট টরন্টোর প্যাভিলিয়ন মঞ্চে বদরুল আনাম সৌদ রচিত ও নির্দেশিত 'একটি কাল্পনিক সত্যি কাহিনী' নাটকের মঞ্চায়ন হয়। নাটকের প্রধান তিনটি চরিত্র। রেবেকা, অপর্ণা ও দেবদূত। অভিনয় করেছেন সুবর্ণা মুস্তাফা, চিত্রলেখা গুহ ও আহমেদ হোসেন। নাটকটির শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ করেছেন উত্তম গুহ। চলিস্নশ মিনিটের এই নাটকটি উপভোগ করেন মিলনায়তন ভর্তি দর্শক। দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় মুগ্ধ হয়েছেন অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। ঢাকা থিয়েটারের হয়ে মুনতাসীর ফ্যান্টাসি, শকুন্তলা', কসাই, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, যৈবতী কন্যার মন দর্শকপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হন সুবর্ণা মুস্তাফা। নব্বই দশকের পর থেকে তিনি আর মঞ্চে অভিনয় করেননি। সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, 'মঞ্চের জন্য সব সময় মন কাঁদে। কিন্তু সময় সুযোগের অভাব ও নানান কর্ম ব্যস্ততার কারণে মঞ্চে ফিরব ফিরব করেও ফেরা হয়নি। দীর্ঘ ২৫ বছর পর সেই লালিত স্বপ্ন আবার পূরণ হলো। খুব ভালো লেগেছে দর্শকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখে। ঠিক যেন ২৫ বছর আগের সেই আবহ। দর্শক যে এখনও এভাবে আনন্দের সঙ্গে মঞ্চ নাটক উপভোগ করেন- তাও দেখা হলো।' ফিরে আসা যাক চলতি বছরে। মঞ্চের মতো দীর্ঘদিন পর এ বছর উপস্থাপনায় ফিরেছেন তিনি। ১৬ জানুয়ারি থেকে নিউজ টোয়েন্টি ফোর চ্যানেলের 'কুইজিং টাইম' শিরোনামের একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন তিনি। অনুষ্ঠানটি সপ্তাহের প্রতি বুধ ও বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় প্রচার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ৩২ শিক্ষার্থীর এতে প্রতিযোগী হিসেবে অংশ নেন। ২২ পর্বের 'কুইজিং টাইমে'র ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে ২৮ মার্চ। এ বিষয়ে সুবর্ণা বলেন, উপস্থাপনা আমাকে তেমন টানে না। নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয়েই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। গত বছর অভিনয়েই বেশি সময় দিয়েছি। হঠাৎ উপস্থাপনার জন্য এক প্রকার জোর করা হয় আমাকে। একান্ত অনুরোধেই উপস্থাপনায় ফেরা। তবে উপস্থাপনা করতে ভালোই লাগছে। নতুন নতুন সব মেধাবী প্রতিযোগীদের মেধা যাচাই করতে নিজের মনের মধ্যেও একটা গর্ব কাজ করছে। আমাদের দেশে এত মেধাবী ছেলেমেয়ে আছে, ভাবতে ভালোই লাগছে।' এক জীবনে অংসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন সুবর্ণা। সেন্সর বোর্ডের সদস্য হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্রের নির্বাচক হিসেবেও কাজ করেছেন। এ ছাড়া একজন ক্রিকেট ফ্যান হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে 'রেডিও ভূমি'তে ধারাভাষ্যকারের কাজটাও করে চলেছেন। একজন সুনাগরিক হিসেবেও নিজের দায়িত্ব সবসময় পালন করে গিয়েছেন তিনি। ২০১৫-১৬ কর বছরে দেশের হয়ে 'অভিনেতা/অভিনেত্রী' শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি কর দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সম্মাননা পত্র এবং ট্যাক্স কার্ডও পেয়েছেন। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এ বছর তার একুশে পদকপ্রাপ্তি। অভিনয়ে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদক পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত অভিনয় ও সংগীতজগতের অনেকে। বিষয়টি নিয়ে নিজেও অনেক উচ্ছ্বসিত। সুবর্ণা বলেন, 'নিঃসন্দেহে এটা অসম্ভব একটা গর্বের মুহূর্ত। রাষ্ট্র যখন একজনকে স্বীকৃতি দেয়, তখন অনুভূতিটা হয় অন্যরকম। সেই একজন যখন আমি, ভালো লাগা যে আরেকটু বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। পুরস্কার দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। আগামী দিনে যাতে কাজ ঠিকমতো কওে যেতে পারি, সেই চেষ্টা করে যাব সবসময়।' রাষ্ট্রীয় এ স্বীকৃতির বিশেষত্ব সুবর্ণা মুস্তাফার কাছে যথেষ্ট সম্মানের। বলেন, 'এটি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার। একটা দেশের অন্যান্য যে কোনো অর্জনের থেকে এটি অনন্য। আরেকটা বিষয়, দেশ আমার কাছে সব সময় আগে। দেশকে অতিক্রম কওে কোনো কিছু নয়। দেশের সঙ্গে চলি আমরা। একুশ নামটাই তো অদ্ভুত, মনের ভেতর অন্যরকম একটা অনুভূতি সৃষ্টি করে। আমি খুবই খুশি।' তবে এই পুরস্কারের কৃতিত্ব সবার বলে মনে করেন সুবর্ণা। অভিনয় একক কিছু নয় বলেও মত দেন তিনি। জানান, 'এককভাবে আর অভিনয় হয় না। আমার এই অর্জন সেলিম আল দীন, আবদুলস্নাহ আল মামুন, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, বাবা গোলাম মুস্তাফা, হুমায়ুন ফরীদি, রাইসুল ইসলাম আসাদসহ আমার সব সহশিল্পী, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার কলাকুশলী প্রত্যেকের সঙ্গে ভাগ করতে চাই। আমার এই চলার পথে সবারই অবদান আছে।' প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে একুশে পদক নেয়া প্রসঙ্গে সুবর্ণা বলেন, 'এটা অনেক অনেক বিশাল সম্মানের ব্যাপার। আমি খুবই খুশি। জীবিত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার নিতে পারাটা বিরাট ঘটনা।' এই সম্মানের পাশাপাশি সংসদে মহিলা সংরক্ষিত আসনের সদস্য মনোনীত হয়েছেন তিনি। নতুন এ পরিচয়ের প্রাপ্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। সুবর্ণা মুস্তাফার জন্য এটি সম্পূর্ণই নতুন এক অভিজ্ঞতা। তিনি নিজেও একজন দেশপ্রেমিক। তার কাছে দেশের ঊর্ধ্বে কোনো কিছুই নয়। প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চান তিনি; নিজের পক্ষে থেকে শতভাগ সেই চেষ্টাই করবেন বলে জানান। অনেক বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। তবে নারী ও শিশু অধিকার, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ওপর বেশি জোর দিতে চান। এ ছাড়া তার ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত হবে সেটিও একনিষ্ঠভাবে করার চেষ্টা করবেন বলে জানান সুবর্ণা মুস্তাফা। সবশেষে আগামী ভাবনা প্রসঙ্গে সুবর্ণা মুস্তাফা বলেন, 'আমি সবসময় সাধারণ। সবার সঙ্গে মেশার চেষ্টা করি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমার কোনো পার্থক্য নেই। আমি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। এ ক্ষেত্রকে ছাড়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। দৈায়া করবেন, এভাঊেন যেন সারাজীবন চলতে পারি।'