সিনেমার গানে আগ্রহ নেই দর্শকের

প্রকাশ | ১৪ মার্চ ২০১৯, ০০:০০

মাসুদুর রহমান
শাকিব খান ও বুবলী অভিনীত 'বসগিরি' ছবির 'দিল দিল' গানটি শ্রোতারা লুফে নিয়েছিল
আমাদের উপমহাদেশের চলচ্চিত্র হচ্ছে গাননির্ভর। গানই চলচ্চিত্রের প্রাণ। কিন্তু চলচ্চিত্রের গানে এখন আর প্রাণ নেই। এখন আর আগের মতো প্রেক্ষাগৃহ থেকে বের হয়ে দর্শকরা গুনগুন করে গান গায় না। চলচ্চিত্রের নিয়মিত কোনো দর্শক কিংবা গানের শ্রোতার কাছে যদি গত পাঁচ বছরে বাংলা ছবির জনপ্রিয় কয়েকটি গানের নাম জানতে চাওয়া হয় তাহলে, তার মাথায় হাত উঠে যাবে। ক্ষণিক সময় গভীর চিন্তা করেও কোনো গানের নাম খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ। হয়তো দু'একটি গান পাওয়া যাবে, যেগুলো সামান্য সময়ের জন্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে আবার। অথচ সত্তর, আশি কিংবা নব্বই দশকের চলচ্চিত্রের অনেক গান এখনও কানে বাজে। সেই সময়ের দর্শকরা ওইসব গানের প্রথম লাইন শুনলেই পরের অংশ বলে উঠেন। শুধু সিনেমার গানই নয়, গানে ঠোঁট মেলানো নায়ক-নায়িকার এমনকি কেউ কেউ গানের শিল্পীর নামও মুখস্থ। 'সুজন সখি' সিনেমায় 'সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা' গানে ঠোঁট মিলিয়ে ছিলেন ফারুক-কবরী, 'মেঘ বৃষ্টি বাদল' সিনেমায় রুনা লায়লার কণ্ঠে 'ও বন্ধু রে প্রাণ বন্ধুরে- কবে যাব তোমার বাড়ি' গানে ঠোঁট মিলিয়ে ছিলেন সুচরিতা, 'নরম গরম' সিমোয় একই শিল্পীর কণ্ঠে 'এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেওনা' গানে গানে দর্শক মাতিয়েছেন অঞ্জু ঘোষ, 'দুই জীবন' সিনেমায় 'আমি একদিন তোমায় না দেখিলে' ঠোঁট মিলিয়েছিলেন আফজাল হোসেন-দিতি, 'গোলাপী এখন ট্রেনে' সিনেমায় সৈয়দ আব্দুল হাদির কণ্ঠে 'আসেন আমার মুক্তার-আসেন আমার ব্যারিস্টার' গানে আনোয়ার হোসেনের অভিনয়, 'দুই পয়সার আলতা' সিনেমায় 'এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই' গানে শাবানার অভিনয় দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। নব্বই দশকে 'চাঁদনী' সিনেমায় 'বন্ধুর বাঁশি বাজেরে আমার কানে কানে', 'পড়েনা চোখের পলক', এইসব গানগুলো এখনও যে কোনো শ্রেণির দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। তাইতো এখনও তারকারা স্টেজে এসব সিনেমার গানের পারফর্ম করে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন রিয়েলিটি শো এবং টিভি অনুষ্ঠানেও নতুনদের কণ্ঠে এসব গানের কদর আছে। রিমেক করে গাওয়া হচ্ছে সে গানগুলো। \হসে সময় অ্যালবামের গানের চেয়ে সিনেমার গানই প্রিয় ছিল শ্রোতাদের কাছে। এখন সিনেমার গানে কথা কাজে মিল না থাকার মতো অবস্থা। গল্পের সঙ্গে গানের কোনো সামঞ্জস্য নেই। হুট করেই গান চলে আসে গল্পের মাঝে। অনেক ছবিতে তো সিনেমার দৈর্ঘ্য বাড়ানোর জন্যই গান ব্যবহার করা হয়। গানের কথার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সুরেও নেই নতুনত্ব। গীতিকার হয়তো জানেন না তিনি কি লিখছেন। এইতো গেল বছরে 'দহন' সিনেমার একটি গানের অশ্লীল কথার বিষয়টি তো সবারই জানা। অবশ্য তোপের মুখে পড়ে মুক্তির আগে গানটি সংশোধন করতে বাধ্য হন পরিচালক। তবে কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। ভালো করার চেষ্টা ও চর্চা হচ্ছে। যার সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। ভালোর চর্চা কম বলে সিনেমার গান জনপ্রিয় হওয়ার আশাও কম। আদৌও সিনেমার গানের সোনালি দিন ফিরবে কী না সন্দেহ। ষাট থেকে নব্বই দশকেও সিনেমার নির্মাতারা সুরকার ও গীতিকারদের নিয়ে গবেষণা করতেন। গানের ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় সিনেমার গল্পও সাজানো হতো। আবার গানকে প্রাধান্য দিয়ে সিনেমায় বাড়তি সিকু্যয়েন্স যুক্ত করা হতো। আর এখন অনেক ক্ষেত্রে সিনেমা দীর্ঘ করতে, গান থাকতে হয় বলেই সিনেমায় গান ব্যবহার হয়। যা সিনেমার গানের অবক্ষয় ডেকে আনছে। বর্তমানে গানের মৌলিকত্ব হ্রাস পাচ্ছে। তাই শ্রোতাদের মনেও স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারছে না সিনেমার গান। গীতিকার কে জি মোস্তফা, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, আমজাদ হোসেন, আহমেদ জামান চৌধুরী, রফিকুজ্জামানসহ অনেকের লেখা গান চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কালজয়ী হয়ে আছে। তেমনি সুরের ক্ষেত্রে সত্য সাহা, রবীন ঘোষ, সুবল দাস, আলাউদ্দিন আলী, বশীর আহমেদ, আলম খান, আনোয়ার পারভেজ, খান আতাউর রহমান, হ্যাপি আকন্দ, লাকি আখন্দ, আলতাফ মাহমুদ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, শেখ সাদী খানদের সুর করা গান আজও মানুষের হৃদয় লেগে আছে। এ প্রজন্মের সুরকার, গীতিকাররাও যে ভালো করছেন না এমনটা নয়। কিন্তু সেটা তুলনায় খুবই কম। এ নিয়ে আলম খান তারারমেলাকে বলেন, 'যুগের সঙ্গে সব পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন আর সিনেমার গানে মেলডি পাচ্ছি না। বাংলা গানের সঙ্গে সংমিশ্রণও হয়ে গেছে। আগে আমরা একটি সিনেমার গানের জন্য গীতিকার সুরকার ও শিল্পীরা মিলে যে পরিশ্রম করতাম। যে যত্ন নিয়ে কাজ করতাম এখন তা হয় কিনা আমার জানা নেই। আগে সিনেমার গল্পের সঙ্গে গানের মিল ছিল। দৃশ্যের সঙ্গে গানের মিল ছিল। গানের আগের সিকু্যয়েন্সের সঙ্গে গানের মিল ছিল। এখন ছবির দৃশ্যেও সঙ্গে গানের মিল খোঁজে পাওয়া যায় না। হুট করে কি থেকে কি যেন হয়। ছবির দৃশ্যেও যা বলে গানের কথা তা বলে না। গানের কথা ও সুরের ঘাটতি থাকে। আগে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, বশির আহমেদ, সৈয়দ আব্দুল হাদি, অ্যান্ডু্র কিশোরের মতো শিল্পীও এখন নেই।'