মৌসুমীর স্মৃতিকথা

কোথায় হারাল সেই দিনগুলো

প্রকাশ | ১১ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
মৌসুমী
আমি বেড়ে উঠেছিলাম খুলনা শহরে। এই শহরটিতে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে যখন শহরের পথে বের হতাম, দেখতাম দোকানে দোকানে পহেলা বৈশাখের হালখাতা পালন হচ্ছে। হালখাতার এ দিনটিতে আমাদের বাড়িতে আনন্দের ধুম পড়ে যেত। বাজারের দই, মিষ্টিতে ভরে যেত বাড়ি। বাবা খুব সকালে উঠে বাজারে চলে যেতেন। ঝুড়ি ভরে ইলিশ মাছ ও ব্যাগ ভরে বাজার করে বাসায় ফিরতেন। প্রতিবছর এ দিনটিতে আমাদের বাড়িতে অনুষ্ঠানের আয়োজন চলত। আত্মীয়স্বজনসহ পাড়া-প্রতিবেশীরা আসতেন। ছোট ছোট বাচ্চারা তো থাকতই। আমাদের বারান্দা ও উঠান ভরে খাবার পরিবেশন করা হতো। খুলনায় আমাদের বাড়ির ওই সব ঘটনার স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে। আরো মজার ঘটনা আছে, বাবা যেসব দোকান থেকে নিয়মিত বাজার-সদাই করতেন, হালখাতার দিন ওসব দোকান থেকে হাঁড়ি হাঁড়ি দই-মিষ্টি খুব সকালেই আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছাত। এসব খাবে কে! আমার তখন সাত-আট বছর বয়স। এই বয়সে খুব বেশি খেতেও পারতাম না। তাই মা বেশিরভাগ খাবার বিলিয়ে দিতেন। পহেলা বৈশাখের দিন খুলনা শহরেই অনুষ্ঠান ও মেলা বসত। সেজেগুজে বাবা-মায়ের সঙ্গে বের হতাম। আমার বাবা ছিলেন বেশ শৌখিন মানুষ। ঘুরতে পছন্দ করতেন। মাও তাই। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে পুরো খুলনা শহর চষে বেড়াতাম আমরা। যেখানেই মেলা বসত বাবা সেখানেই যেতেন। মেলার সবকিছু যেন বস্তা ভরে বাসায় নিয়ে আসতেন। বাবা-মায়ের সঙ্গেই ওই ছোট বয়সে নাগরদোলায় উঠেছি। প্রথম ওঠায় বমি করে ফেলেছিলাম। প্রচন্ড ভয়ও পেয়েছি। বুকে চিনচিন করে ব্যথা করে উঠেছে। কয়েকবার নাগরদোলায় ওঠার পর ভয় আর থাকেনি। পরে দারুণ মজা লাগত নাগরদোলায় উঠতে। ছোটবেলায় ঢাকায় চলে আসায় ঢাকাকে ঘিরে পহেলা বৈশাখের স্মৃতিও কম নয়। সেলিব্রেটি হওয়ার আগে স্কুল-কলেজে পড়ার সময় বান্ধবীদের সঙ্গে পহেলা বৈশাখের দিনটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছি। রমনার বটমূল থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি এবং চারুকলার বকুলতলা ছিল আমাদের পায়ে পায়ে। চারুকলার সামনে শিল্পীরা যেসব অঙ্কন করত তা আমি মুগ্ধপ্রাণে দেখতাম। বৈশাখের শাড়ি পরে ঘুরতে কি আনন্দ লাগত তা এখন বলে বুঝাতে পারব না। প্রচন্ড রোদও আমাদের আনন্দে ছেদ ঘটাতে পারত না। এখন ভাবি সেসব দিন কই গেল! সত্যিই হারিয়ে গেছে সেসব দিন। এখন ছবির মতো ভাসে সব। এখন মন চাইলেই তো পহেলা বৈশাখের দিনে বান্ধবীদের সঙ্গে করে ঘুরতে বের হতে পারি না। চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করার পর অনেক কিছু জীবন থেকে হারিয়ে যায় আমার। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করবে না শিল্পী হওয়ায় কত বিধিনিষেধ সামনে এসে দাঁড়ায়। সেগুলো অতিক্রম করার ক্ষমতা থাকে না। স্বাভাবিক জীবন অনেকটাই হারিয়ে যায়। তবে আমি সব সময় চেষ্টা করেছি আর ১০ জন মানুষের মতো জীবনযাপন করার। তারপরও পহেলা বৈশাখের দিন আমার প্রিয় রমনার বটমূল, টিএসসি, চারুকলা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উদাস মনে ঘুরতে পারি না। পারাটা এখন আর সম্ভবও নয়। ফলে এ দিনটি ঘরোয়াভাবেই পালন করতে হয়। সকালে উঠে রমনার বটমূলের মতো বাসায় ইলিশ ও পান্তা ভাতের আয়োজন করে থাকি। মিষ্টি ছাড়া অবশ্য এ দিনটি একদমই অচল বলে আমার কাছে মনে হয়। প্রত্যেক পহেলা বৈশাখের দিন আমার স্বামী ওমর সানীর কাছ থেকে শাড়িসহ নানা ধরনের উপহারসামগ্রী পাই। আমিও তাকে বৈশাখের পাজামা-পাঞ্জাবি, ফতুয়া উপহার দেই। এ ছাড়া আমার মেয়ে ফাইজা ও ছেলে ফারদিনের জন্য অনেক কিছু কিনতে হয়। আমার মেয়েটি আমার মতোই সাজগোছ করতে চায়। আমি অবাক হই ওর এসব কান্ড দেখে। মনে মনে আনন্দও লাগে। এখন আর পহেলা বৈশাখের দিনটিতে তেমন কোথাও বের হই না। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমরা ঘরেই সময় কাটাই। ঢাকার যা অবস্থা কোথঠর বের হওয়াটাই কষ্টকর। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে দাবদাহের মধ্যে বাইরে বের হতেও মন চায় না। এখন যদি বান্ধবীরা মিলে রমনার বটমূলে সারা মধ্য দুপুর আনন্দ চিত্তে সময় কাটিয়ে দিতে পারতাম কি আনন্দই না লাগত। কোনো ক্লান্তি থাকত না তাতে। রমনার বটমূল, চারুকলা, টিএসসি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে একটুও খারাপ লাগত না। ছেলে-বুড়ো-বুড়ি থেকে শিশু বাচ্চারা পর্যন্ত ঢলের মতো পহেলা বৈশাখের দিন নেমে আসে। এদের সঙ্গে যদি মিশে যেতে পারতাম খুব ভালো লাগত। তবে এসব এখন কল্পনা ও স্বপ্ন মনে হয়। সবাইকে নব বর্ষের শুভেচ্ছা। শ্রম্নতিলিখন