শিবলী মোহাম্মদ কত্থক নৃত্যের মনোহর শিল্পী

শিবলী মোহাম্মদ বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রধান ক্ল্যাসিকাল ভারতীয় নৃত্যশিল্প 'কত্থক' ধারার শিল্পী। 'কত্থক' নাচে যিনি এ দেশের পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে একদম তুলনারহিত। যার নৃত্যের অভাবনীয় দোলা দর্শককে সম্মোহিত করে রাখে। যার সুগঠিত শরীরে নাচ সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে কেমন ঐশ্বরিক তরঙ্গ বয়ে যায় দর্শকের মনে। শিল্পকলা একাডেমির প্রধান পুরুষ নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ। নৃত্যেও জনপ্রিয় শিল্পী হওয়া যায় এ দেশে পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে শিবলী এক উজ্জ্বল তারকা।

প্রকাশ | ২৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
শিবলী মোহাম্মদ
শিবলী মোহাম্মদ বাংলাদেশের একজন অন্যতম প্রধান ক্ল্যাসিকাল ভারতীয় নৃত্যশিল্প 'কত্থক' ধারার শিল্পী। এছাড়াও একজন নৃত্য শিক্ষক ও প্রশিক্ষক। 'কত্থক' নাচে যিনি এ দেশের পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে একদম তুলনারহিত। যার নৃত্যের অভাবনীয় দোলা দর্শককে সম্মোহিত করে রাখে। যার সুগঠিত শরীরে নাচ সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে কেমন ঐশ্বরিক তরঙ্গ বয়ে যায় দর্শকের মনে। শিল্পকলা একাডেমির প্রধান পুরুষ নৃত্যশিল্পী শিবলী মোহাম্মদ। নৃত্যের মাধ্যমেও যে জনপ্রিয় শিল্পী হওয়া যায় এ দেশে পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে শিবলী এক উজ্জ্বল তারকা। তাই তো তার এমন উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে গৌরবান্বিত করা হলো এবার। দেশের শোবিজ অঙ্গনের মধ্যে নৃত্যকলা থেকে এমন গৌরবের অধিকারী খুব বেশি নৃত্যশিল্পী হননি। নৃত্যকলায় এ দেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম একুশে পদকে গৌরবান্বিত হন। তিনি ছিলেন গওহর জামিল (গনেশচন্দ্র নাগ)। এ ছাড়া আরও যারা এ পদকে ভূষিত হন তাদের মধ্যে গাজী আলিমুদ্দিন মান্নান (জি এ মান্নান), রাহিজা খানম ঝুনু, রওশন জামিল, রুনু বিশ্বাস, আলতামাস আহমেদ, লায়লা হাসান, আমানুল হক, শামীম আরা নিপা, মীনু হক, জিনাত বরকতুলস্নাহ এবং সর্বশেষ শিবলী মোহাম্মদ। অর্থাৎ একুশে পদক প্রবর্তনের প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে মাত্র ১১ জন নৃত্যশিল্পী এই পদকের গৌরবে গৌরবান্বিত হয়েছেন। দেশের হাজার হাজার নৃত্যশিল্পীর মধ্যে এই ১১ জন একুশে পদক পাওয়ার মধ্যে প্রমাণিত হয় এ দেশের নৃত্যশিল্পী একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হলেও নৃত্যশিল্পে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া শিল্পী এ দেশে খুব বেশি জন্মায়নি। আবার এখন একুশে পদক পাওয়া এই ১১ জনের মধ্যে যদি কাউকে সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে বাছাই করতে বলা হয় তাহলে নিঃসন্দেহে শিবলী মোহাম্মদের নামই আসবে সবার আগে। যিনি ভারতীয় কত্থক নৃত্যকে দিয়েছেন এক অনন্য মাত্রা। আবার তিনি যাকে তার নৃত্যকলার জন্য জুটি হিসেবে বেছে নিয়েছেন সেই শামীম আরা নিপাও কত্থক নৃত্যকে দিয়েছেন এ দেশে এক ভিন্ন মাত্রা। তাদের যুগল নৃত্য এ দেশের নৃত্যাঙ্গনকে যতটা বিনোদন দিয়েছে তেমন জুটি নৃত্য বোধ হয় আর কারও মধ্যেই দৃশ্যমান হয়নি। এ দেশে নারী নৃত্যশিল্পীদের নাম করলে যেমন প্রথমেই আসে শামীম আরা নিপার নাম আবার পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের নাম করলেও প্রথমেই আসে শিবলী মোহাম্মদের নাম। কাজেই সর্বশেষ জিনাত বরকতুলস্নাহর একুশে পদক পাওয়ার পর আর কে পেতে পারেন পরবর্তী একুশে পদক। এ নিয়ে নিশ্চয় কারোরই দ্বিমত ছিল না শিবলী মোহাম্মদের নাম নিয়ে এবং যথারীতি তিনি তার পরপরই এবার একুশে পদক পেলেন। সেজন্য তাকে খুব অপেক্ষাও করতে হয়নি। ২০২৩ সালে জিনাত বরকতুলস্নাহ একুশে পদকপ্রাপ্তির পর ২০২৪ সালেই তিনি এ পদক পেলেন। এ দেশের নৃত্যকলার ইতিহাসে গওহর জামিল, বজলুর রহমান বাদল, জি এ মান্নান, আমানুল হকদের পর শিবলী মোহাম্মদকেই ধরা হয় সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল পারফর্মার হিসেবে। তার চোখ ধাঁধানো নৃত্য দিয়ে তিনি দর্শককে যেভাবে সম্মোহিত করে ফেলেছেন- সেটা আর কোনো পুরুষ নৃত্যশিল্পীর ক্ষেত্রে সেভাবে দেখা যায়নি। বলা চলে, শিবলী মোহাম্মদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের একজন। তিনি একজন সুপরিচিত নৃত্যাভিনয় শিল্পী এবং কোরিওগ্রাফার, কত্থকের জাঁকজমকপূর্ণ নৃত্যে বিশেষজ্ঞ। এ দেশে নারী নৃত্যশিল্পীদের অনেকে সুপরিচিত হলেও পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের ক্ষেত্রে এমন পরিচিতি অর্জন খুব কম পুরুষ নৃত্যশিল্পীর ভাগ্যেই জুটেছে। ব্যতিক্রম শুধু শিবলী মোহাম্মদ। নৃত্যের মধ্য দিয়ে তার যে ব্যাপক পরিচিতি হয়েছে সেক্ষেত্রে তিনিই যে এ দেশের প্রথম ক্লাসিক নৃত্যশিল্পের সুপারস্টার এতে কারো সংশয় থাকার কথা নয়। সেক্ষেত্রে এবার যে কয়জনকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে নিঃসন্দেহে সেইসব যোগ্যদের অন্যতম শিবলী মোহাম্মদ। আবার এটাও ঠিক যে, এ পর্যন্ত যে ১২ জন নৃত্যশিল্পীকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে তারা সবাই যোগ্য হিসেবেই এ পদকপ্রাপ্ত হয়েছেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে কমবেশি বিতর্ক হলেও এ দেশের সাহিত্য ও শিল্পকলার ইতিহাসে একমাত্র নৃত্যশিল্পই হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যেখানে চূড়ান্ত পরীক্ষিত পারফর্মাররাই এই পদকে ভূষিত হয়েছেন। নৃত্যশিল্প এমন একটি মাধ্যম যেখানে পারফর্মেন্সই সব কথার শেষ কথা। কে কেমন করছে সেটার বিচারক প্রথমেই দর্শক। সেখানে ফাঁকির কোনো জায়গা নেই। কাজেই এ মাধ্যমে যারাই পুরস্কৃত হয়েছেন তারা তাদের কাজের ষোলোআনা পূরণ করেই পুরস্কৃত হয়েছেন। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যান্য মাধ্যমে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও এ মাধ্যমে সেরকম বিতর্কের অবকাশ নেই। যেমন, সঙ্গীতে শিবলী মোহাম্মদের বড় ভাই সাদী মহম্মদ এ দেশের রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথিতযশা শিল্পী ছিলেন- এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। যিনি ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের মহাতারকা। কিন্তু তারপরেও তাকে একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকের মতো বড় মাপের পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। অথচ রবীন্দ্রসঙ্গীতে ইতিপূর্বে এমন অনেকে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন যেখানে তাদের আগেই সাদী মহম্মদ এই পদকে ভূষিত হতে পারতেন। সেটা পাননি, ভবিষ্যতে হয়তো মরণোত্তর পুরস্কার হিসেবে এই পদকে ভূষিত করা হবে। কিন্তু তখন সে পুরস্কারে কার কি আসে যায়। কার কোন মনে আনন্দ হবে। তবে কোনো অজ্ঞাত কারণে সাদী মহম্মদকে বারবার এ পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে সেটা হয়তো তারাই ভালো বলতে পারবেন- যারা এর নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত আছেন। তবে শিবলী মহম্মদকে আরো অন্যান্যদের সঙ্গে যেদিন এই পুরস্কারে ভূষিত করা হবে সেদিন সেই অনুষ্ঠানে সাদী মহম্মদ লজ্জাতেই যাননি। এ থেকেই আন্দাজ করা যায়, নিজেকে নিয়ে তিনি কী মনোবেদনার মধ্যে ছিলেন। তবে বড় ভাইয়ের এই না পাওয়া বেদনা ছোট ভাই হিসেবে শিবলী মোহাম্মদকেও কম দগ্ধ করেনি। তাই তো তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমার ভাইয়ের অনেক অভিমান ছিল। ও মনে করত, তাকে মূল্যায়ন করেনি। আমরা বোঝাতাম, তোমাকে হাজার কোটি লোক ভালোবাসে। তোমার গান ভালোবাসে। এটাই তো তোমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। কী হবে এত পদক দিয়ে, এত কিছুই তো মানুষ পায়। আমার ভাইকে নিয়ে কখনো কেউ ভাবেনি। এটা নিয়ে ওর মনে অনেক কষ্ট ছিল। ওর অনেক সময় অভিমান হতো এটা হয়নি, ওটা হয়নি। বোঝাতাম, দরকার নেই। আমরা তো কিছু প্রাপ্তির জন্য কাজ করি না। ভালোবেসে আমরা কাজ করি। অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু ওর ভেতরে ছিল চাপা কষ্ট।' শহীদ পরিবারের দুই কৃতী সন্তান। একজন সাদী মহম্মদ এবং আরেকজন শিবলী মোহাম্মদ। শিবলী পড়াশোনা করেছেন বিজ্ঞান বিভাগে আর তার ক্যারিয়ার গড়তে মনোযোগ দিলেন শিল্পকলায় এটাই তো বেশ চিত্তাকর্ষক। তার বড় ভাই সম্প্রতি আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সাদী মহম্মদও ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। পড়াশোনা করেছেন বুয়েটে। এমন একাডেমিক ক্যারিয়ারের মধ্যেও একটি পরিবার যেখানে শিল্পকলার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন, দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বড় ভূমিকা রাখেন, সে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তারা তো অনিবার্যভাবেই এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য হতে পারেন। সর্বশেষ একুশে পদক প্রাপ্তির আগে আরও অনেক সম্মাননা লাভ করেছেন শিবলী মোহাম্মদ। এর মধ্যে আছে, সেরা বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পীর জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার, নৃত্যের জন্য জর্জ হ্যারিসন পুরস্কার, যায়যায়দিন পুরস্কার, বাসাস পুরস্কার, প্রথম আলো পুরস্কার ও লাক্স চ্যানেল আই পুরস্কার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করা শিবলী কার্তিক সিং, অজিত দে এবং অনিতা দে'র কাছ থেকে ঢাকার ছায়ানটে নৃত্যের পাঠ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রশিক্ষণের জন্য ভারত সরকারের বৃত্তি লাভ করেন। ভারতের লক্ষ্নৌয়ের ভাটখন্ডে সঙ্গীত ইনস্টিটিউটে শ্রীমতি পূর্ণিমা পান্ডের কাছে নাচ শিখেছিলেন। এর পরে তিনি নয়াদিলিস্নর জাতীয় কত্থক নৃত্যের ইনস্টিটিউটে বীরজু মহারাজের অধীনে পড়াশোনা করেন। শিবলী ব্যালে এবং সমসাময়িক নৃত্যের পাশাপাশি লন্ডন ব্যালে থিয়েটার স্কুলে এক বছরের জন্য ট্যাপ এবং জাজের প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। নৃত্যকল্পার ওপর তার এই শিক্ষা অভিযানের মধ্যেও দেখা যায় নৃত্যের জন্য শিবলী মোহাম্মদ কতটা ডেডিকেটেড।