মঞ্চেই স্বস্তি খুঁজছেন সিনিয়র শিল্পীরা

মঞ্চকে বলা হয় অভিনয়ের বিদ্যাপীঠ। বেশিরভাগ তারকা শিল্পীরই অভিনয়ে অভিষেক ঘটেছে মঞ্চ দিয়ে। এরপর টেলিভিশনে এসে মঞ্চকে ভুলে টিভি নাটককেই পেশা হিসেবে বেছে নেন অনেকেই। আবার অনেকে মনের টানে এবং ভালোবাসার টানে দুটোতেই সময় দেন। কিন্তু এমন কিছু শিল্পী আছেন যারা এক সময় টিভি নাটকে ব্যস্ত সময় পার করলেও এখন শুধু মঞ্চেই সময় দিচ্ছেন। মঞ্চতেই স্বস্তি খুঁজছেন। লিখেছেন মাসুদুর রহমান-

প্রকাশ | ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
লাকী ইনামকে দিয়েই শুরু করা যাক। ১৯৭২ সালে 'নাগরিক নাট্য সমুদ্র' নাট্যদলে যোগ দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন বরেণ্য এই অভিনেত্রী। এরপর ১৯৮৭ সালে 'অনুভবে অনুভূতি' নাটকের মাধ্যমে তিনি প্রথম টিভি নাটক করেন। তারপর অনেক নাটকে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার বিখ্যাত কিছু চরিত্র ছিল শরমার 'কণা', নুরুলদিনের সারাজীবনে 'আম্বিয়া', বহুব্রীহি'র 'জনাবা ইশা', অয়োময়'তে 'বড় বউ'। একুশে পদকপ্রাপ্ত এ অভিনেত্রী ছোটপর্দায় সফলতা পেলেও এখন তিনি টিভি নাটকে অভিনয় করেন না। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যস্ত রয়েছেন মঞ্চে। মঞ্চ নাটকের প্রসিদ্ধ সংগঠন 'নাগরিক নাট্যাঙ্গন' ও 'নাগরিক নাট্যাঙ্গন ইনস্টিটিউট অব ড্রামা' নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত সময় কাটে তার। মঞ্চের জন্য নাটক লিখছেন, অভিনয় করছেন ও নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি মঞ্চে এনেছেন নতুন নাটক 'ক্রীতদাসের হাসি'। শওকত ওসমানের উপন্যাস অবলম্বনে এ নাটকটি তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। লাকী ইনামের নির্দেশিত উলেস্নখযোগ্য মঞ্চ নাটকগুলো হলো, 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি', 'শারমা', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সেইসব দিনগুলি', 'বিদেহ' এবং 'মুক্তির উপায়'। লাকী ইনাম বলেন, 'এক সময় টিভি নাটকে অভিনয় করলেও এখন শুধুই মঞ্চ নিয়ে ব্যস্ত। আমি নিয়মিতভাবে থিয়েটার চর্চা করে যাচ্ছি। ১৯৯৫ সালে নাগরিক নাট্যাঙ্গনের যাত্রা শুরু হয়। এ দলের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ওপর। সব কিছু সামলাতে হয় নিজেকে। একটি দল পরিচালনা করা, নাটক প্রযোজনা ও প্রদর্শন করতে হয় নিয়মিত। দিন দিন ব্যস্ততা বেড়ে যায়। মঞ্চ নিয়েই প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি। অন্যদিকে ২০০৫ সালে এনএনআইডি (নাগরিক নাট্যাঙ্গন ইনস্টিটিউট অব ড্রামা) এর কাজ শুরু হয়। এখান থেকে বছরে দুটি ব্যাচ শিক্ষা সমাপন করে বের হয়। একটি ড্রামা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা খুব কঠিন কাজ। আমার নির্দেশিত মঞ্চের নতুন নাটক 'লাল লাটিম' নিয়ে কাজ করছি। এটি লিখেছিও আমি। সব কিছু মিলিয়ে টেলিভিশন নাটকে আর সময় দেয়া হয়ে ওঠে না।' প্রখ্যাত গুণী অভিনেতা আলী যাকের। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অভিনেতা মঞ্চ, টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রে সমান জনপ্রিয়। বাংলার গ্যালিলিও খ্যাত এই অভিনেতা এক সময় টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্র দাপিয়ে বেড়ালেও দীর্ঘদিন পর্দায় নেই। টেলিভিশন নাটক ও চলচ্চিত্রে তাকে দেখা না গেলেও অভিনয় করছেন মঞ্চে। গত বছরের শেষের দিকে আরণ্যক নাট্য সম্প্রদায় ঢাকার মঞ্চে আনে 'গ্যালিলিও'। ২০ বছর পর নাটকটি নতুন করে মঞ্চে আসে। পান্থ শাহরিয়ারের নির্দশনায় এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন আলী যাকের। আলী যাকের অভিনীত উলেস্নখযোগ্য ছবি- ১৯৮৬ সালের 'আগামী' ১৯৯৬ সালের নদীর নাম 'মধুমতি', ২০০১ সালের 'লালসালু', ২০০৮ সালের 'রাবেয়া'। ১৯৭২ সালে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে প্রথম মঞ্চে অভিনয় করেন। এরপর ১৯৭৩ সালে মঞ্চে প্রথম নির্দেশনা দেন বাকি ইতিহাস নাটকের। আলী যাকের বলেন, 'শরীর যতদিন ভালো থাকবে, মঞ্চ নাটকে ততদিনই অভিনয় করার ইচ্ছা আছে আমার। মঞ্চে আমি সব ধরনের নাটকেই অভিনয় করে যেতে চাই। আর টেলিভিশন নাটকের প্রতি তেমন কোনো টান নেই আমার। এখন আগের মতো সে রকম ভালো গল্প পাওয়া যায় না। বর্তমানে টেলিভিশন নাটকের মান হারিয়ে গেছে। আমার কাছে টেলিভিশন নাটকে কাজ করা মানে সময় অপচয় মনে হয়। যতটুকু মনে পড়ে সর্বশেষ টেলিভিশন নাটকে কাজ করেছিলাম তিন/চার বছর আগে। কোন নাটকে কাজ করেছিলাম তার নামটাও মনে নেই।' আরেক গুণী অভিনেতা আতাউর রহমান। মঞ্চের পাশাপাশি টিভি নাটকে অভিনয় করেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। টিভি নাটকে না হলেও এখন মঞ্চেই ব্যস্ত তিনি। মঞ্চ নাটক নির্দেশক ও লেখক আতাউর রহমান। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তী মঞ্চনাটক আন্দোলনের অগ্রদূত। মঞ্চনাটকে তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদক ভূষিত করে। এক সময় টিভি নাটকে ব্যস্ত থাকলেও এখন মঞ্চে অভিনয় এবং নির্দেশনা, দুটোই সমানতালে করে যাচ্ছেন অভিনেত্রী ত্রপা মজুমদার। নিজের দল থিয়েটারের বিভিন্ন নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনাও দেন। 'কুহকজাল' নাটকে তার নির্দেশনা দর্শক মহলে দারুণ সাড়া ফেলে। নব্বই দশকে টেলিভিশন নাটকে দর্শক প্রিয়তা পান তনিমা হামিদ। এখন তাকে টেলভিশন নাটকে দেখা যায় না। টিভি পর্দায় নিয়মিত না হলেও এখন কাজ করছেন মঞ্চে। গত মার্চে মঞ্চে আসে তার একক অভিনয়ের নাটক 'একা এক নারী'। নাট্যচক্রের ৫৪তম প্রযোজনার এ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন দেবপ্রসাদ দেবনাথ। এ সংগঠনের হয়ে তনিমার মঞ্চে অভিনীত নাটক 'ভদ্দরনোক', 'লেট দেয়ার বি লাইট', 'হায়েনা' 'বিলকিস বানুর কন্যারা' উলেস্নখযোগ্য। তনিমা হামিদ অভিনীত টিভি নাটক 'খোঁজ', 'দায়বন্ধন', 'বগুড়ার স্যার', 'টমটম', 'শিল্পী', ' দৈনিক তোড়পাড়',। ধারাবাহিক নাটক 'ডটকম ফ্যান্টাসি'। অভিনেত্রী তমালিকা কর্মকার এক সময় টিভি নাটকের ব্যস্ত অভিনেত্রী ছিলেন। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। 'অন্য জীবন' দিয়ে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক। তমালিকা অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হলো, 'এই ঘর এই সংসার', 'কিত্তনখোলা', ও 'ঘেটুপুত্র কমলা'। 'কিত্তনখোলা' ছবিতে অভিনয়ের জন্য ২০০২ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। সর্বশেষ তাকে দেখা গেছে হুমায়ূন আহমেদের 'ঘেঁটুপুত্র কমলা' ছবিতে। এ ছাড়াও অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী, নাজনীন হাসান চুমকি, জয়ীতা মহলানবিশ, তানভিন সুইটি, ত্রপা মজুমদারসহ বেশ কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী আছেন যারা এক সময় টিভি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করলেও এখন তারা অনিয়িমিত। টিভি নাটকের চেয়ে মঞ্চেই বেশি ব্যস্ত থাকেন।