সা ক্ষা ৎ কা র

জীবন ঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে

আলোকিত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রোজিনা। যদিও অভিনেত্রীর চেয়ে নিজের নামের সঙ্গে নায়িকা শব্দটি ব্যবহার করলেই বেশি খুশি হন তিনি। কারণ এখন পর্যন্ত নায়িকা কিংবা কেন্দ্রীয় চরিত্র ছাড়া অভিনয় করতে দেখা যায়নি তাকে। মা কিংবা ভাবির চরিত্রে অভিনয় করতে ঘোর আপত্তি তার। দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই অভিনেত্রী বর্তমানে অভিনয় কম করলেও চলচ্চিত্রের যে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় তাকে। মনের টানে আর ভালোবাসার কারণেই চলচ্চিত্রের সঙ্গে গভীর একটা সম্পর্ক ও সম্পৃক্ততা তার। কারণ চলচ্চিত্রই তাকে রোজিনা বানিয়েছে। চলমান চলচ্চিত্রের নানা প্রসঙ্গ ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারার মেলার সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন রোজিনা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদুর রহমান-

প্রকাশ | ১৮ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
রোজিনা
তারার মেলা : বৈশাখ দিয়েই শুরু করা যাক। কেমন কাটল এবারের পহেলা বৈশাখ? রোজিনা : এবার তো বাংলাদশেই পহেলা বৈশাখ কাটল। এককথায় বলব, ভালোভাবেই কেটেছে। তবে বিদেশে থাকলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে বৈশাখ উৎসব পালন হয়। সেটা আবার অন্য এক আমেজ। প্রবাসী বাঙালিরা অনেক বড় বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন বৈশাখে। তবে আমাদের দেশের মতো শুধু একদিন, বৈশাখের পহেলা দিন উৎসব হয় না। সেখানে একমাস দুই মাসব্যাপী বৈশাখের উৎসব পালন হয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাঙালিরা এসব আয়োজন করে থাকেন। একেক শহরে একেক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বিদেশের মাটিতে বৈশাখের উৎসব কিংবা ঈদের উৎসবে অনেক মজা হলেও বাংলাদেশকে খুব মিস করি। মাতৃভূমিতে সব উৎসবেই আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। তারার মেলা : চলচ্চিত্রে চার দশকেরও বেশি সময় পার করে দিয়েছেন। এখনকার সময়ে এসে কেমন লাগছে? রোজিনা : এ সময়ে এসেও অনেক ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগে যেমন চলচ্চিত্রকে ভালোবাসতাম এখনও চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা রয়ে গেছে। আমি আপাদমস্তক একজন চলচ্চিত্রের মানুষ, মরার আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেই থাকতে চাই। অভিনয়ে এই দীর্ঘ সময়ে অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। ভালো কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার, সম্মান ও সুনাম অর্জন করেছি। চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শুটিংয়ে আমরা একই পরিবারের মতো থেকেছি। আমাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। কারো প্রতি কারো কোনো অভিযোগ ছিল না। বড়দের সম্মান করতাম, ছোটদের স্নেহ করতাম। এখন এ সময়ে এসে আমিও সেই সম্মান পাচ্ছি সবার কাছ থেকে। তারার মেলা : বহু ব্যবসা সফল ছবির নায়িকা ছিলেন। কোন নায়কের বিপরীতে বেশি কাজ করেছেন? রোজিনা : চলচ্চিত্রে আসার পর বাংলাদেশের বাইরেও চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। নেপাল, পাকিস্তান, ভারতসহ প্রায় ৩০০ ছবিতে অভিনয় করা হয়েছে আমার। নায়করাজ রাজ্জাক, আলমগীর, ওয়াসিম, ফারুক, জসিম, মাহমুদকলি, ইলিয়াস কাঞ্চান, সাত্তারসহ অনেকের সঙ্গে কাজ করেছি। তবে বেশি কাজ করেছি ফারুক ও ওয়াসিমের সঙ্গে। তারার মেলা : মনে রাখার মতো কোনো চলচ্চিত্র ... রোজিনা : ১৯৮০ সালে 'কসাই' ও ১৯৮৮ সালে 'জীবন ধারা' ছবি দুটির জন্য আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলাম। এ ছাড়া 'রাজমহল', 'দোলনা' ও 'বিনি সুতার মালা'সহ অনেক ছবির কথাই মনে পড়ে। তারার মেলা : আপনাকে তো অনেক ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করতে দেখা গেছে। আপনি নিজে কোন ধরনের চরিত্রে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন? রোজিনা : আমার সৌভাগ্য যে, সামাজিক ও অ্যাকশানসহ নানা ঘরানার ছবিতে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ফোক গল্পের 'রূপবান' ছবিতে যেমন কাজ করেছি তেমন অ্যাকশান ঘরানার 'সুলতানা ডাকু'র মতো ছবিতেও অভিনয় করেছি। যে ধরনের চরিত্রেই হোক তা সুন্দরভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। কতটা সাবলীল ও সুন্দর হয়েছে তা দর্শকই বিচার করেছেন। তারার মেলা : রাক্ষুসী'র পর প্রায় ২০ বছর পার হলেও নতুন চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন না কেন? রোজিনা : সত্যি কথা হলো, চেহারা দেখানোর জন্য অভিনয় করে তো লাভ নেই। বছরে কয়টি ছবিতে কাজ করলাম তা হিসেব করে কি হবে। আগেই বলেছি, আমি চলচ্চিত্রের লোক। মৃতু্যর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের সঙ্গে থাকতে চাই। অভিনয় না করলেও চলচ্চিত্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে থাকার চেষ্টা করি। দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় না করলেও অভিনয় ছাড়িনি। ভালো চিত্রনাট্য হলে, আমাকে নিয়ে গল্প হলে সেই চলচ্চিত্রে অবশ্যই অভিনয় করব। তারার মেলা : 'বীরাঙ্গনা' শিরোনামের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ছিল আপনার? তার প্রস্তুতি কেমন? রোজিনা: অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছি, নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশকিছু ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছি। নতুন চলচ্চিত্র নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা থেকেই 'বীরাঙ্গনা' চলচ্চিত্রে হাত দেই। এ চলচ্চিত্রের কাজ এগিয়ে রেখেছি। চিত্রনাট্যও তৈরি হয়ে আছে। এটির প্রযোজনা ও পরিচালনা করব নিজেই। এ ছবির কাজ যখন শুরু করব তখন সবাইকে জানিয়ে ঘটা করেই করব। তারার মেলা : একজন প্রকৃত শিল্পীর গুণ কি হতে পারে? রোজিনা: একজন শিল্পীর অবশ্যই শিল্পমন থাকতে হবে। ইমোশন থাকতে হবে। শিল্পমন ও ইমোশন না থাকলে হয় না। প্রকৃত শিল্পী সেই যার কাজের প্রতি ভালোবাসা আছে, কাজ করে। নিজেকে স্টার না ভেবে একজন শিল্পী হওয়ার চেষ্টা থাকে। শেখার প্রচন্ড আগ্রহ থাকতে হবে। আমরা চলচ্চিত্র শিল্পকে ভালোবেসে অভিনয় করেছি। শেখার জন্য দিনের পর দিন চেষ্টা করেছি। সিনিয়রদের থেকে, পরিচালকদের থেকে পরামর্শ নিয়ে ভালো করার চেষ্টা করেছি। অধ্যবসায় না থাকলে কোনো কিছুই ভালো হবে না। তারার মেলা : অতীত ও বর্তমান চলচ্চিত্রের মধ্যে কতটা ব্যবধান দেখতে পাচ্ছেন আপনি? রোজিনা : এখন ছবি হচ্ছে সস্তা লোকের জন্য। যাকে তাকে দিয়ে অভিনয় করানো হচ্ছে। বর্তমানের ছবিগেুলোতে বিদেশি সংস্কৃতির ছোঁয়াটা বেশি। আগের ছবিগুলোতে তা ছিল না। আগের ছবিগুলো ছিল সবার জন্য। মৌলিক গল্পের। পরিবার ও সমাজের কথা বলত। যদিও সময়ের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আধুনিকতার নামে নিজের সংস্কৃতিকে ছোট করা। আমরাও তো আধুনিক ছিলাম। আমাদের সে সময়ের ছবিগুলো দর্শক প্রিয়তা পেয়েছে। এখন প্রযুক্তির যুগ। প্রজন্মকে গুরুত্ব দিয়ে যদি ভালো গল্পের চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় তাহলে অবশ্যই সে ছবিটি সাফল্য পাবে। তারার মেলা : গল্প না শিল্পী? কোনটার গুরুত্ব বেশি বলে মনে করেন? রোজিনা : ভালো গল্পের সঙ্গে সুন্দর নির্মাণ হলে দর্শক ছবিটি অবশ্যই গ্রহণ করে। একটি ভালো গল্পের ছবিতে যদি একজন নতুন শিল্পী সুন্দর অভিনয় করে তাহলে সে ছবিটিও সাড়া ফেলে। এখন শাকিব খানকে দিয়ে যদি দুর্বল গল্পের সিনেমায় কাজ করানো হয় তাহলে দোষটা কার? তারার মেলা : এ সময়ের সিনেমা কি দেখা হয়? রোজিনা : খুব কম ছবি দেখা হয়। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জুরি বোর্ডের সদস্য হওয়াতে যা দেখা হয়। আমি আসলে মৌসুমী, পূর্ণিমা, শাবনুর ও পপি এদের চিনি। তারপরের নায়িকাদের ততটা চিনি না। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য যে সব ছবি জমা পড়ে তার মধ্যে এমন কিছু চলচ্চিত্র আছে যা দেখে মর্মাহত হতে হয়। এসব ছবি কি করে তারা জাতীয় চলচ্চিত্রের মতো জায়গায় জমা দেন তা আমার বোঝে আসে না। নায়িকাদের খোলামেলা পোশাক, বাণিজ্যিক ছবির নামে নিজের সংস্কৃতিকে ছোট করার বিষয়গুলো ভাবতে পারি না। এসব আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন্ন করছে। বাংলা চলচ্চিত্রকে নষ্ট করছে। তবে এর মধ্যে কিছু ভালো ছবিও আছে। সেগুলো প্রশংসিতও হচ্ছে। তারার মেলা : নতুনদের উদ্দেশে যদি কিছু বলতে বলা হয়, তাহলে কি বলবেন? রোজিনা: কাজের শুরুতে সবাই নতুন থাকে। আজকের নতুনরাই এক সময় পুরনো হবে। আমরাও এক সময় নতুন ছিলাম। নতুনদের অবশ্যই আগে মন দিয়ে কাজ করতে হবে। চলচ্চিত্রকে ভালোবাসতে হবে। চলচ্চিত্রে এসেই রাতারাতি স্টার হওয়ার চিন্তা না করে আগে শিল্পী হতে হবে। চলচ্চিত্রে পা দিয়েই গাড়ি-বাড়ি করার চিন্তা করা যাবে না। আগে শিল্পী হও তার পর সব হবে। তারার মেলা : চলচ্চিত্রের চলমান সংকট ও সমস্যাগুলো কিভাবে দূর করা সম্ভব? আপনার নিজস্ব ধারণা যদি একটু ব্যাখ্যা করতেন- রোজিনা : আমি বলব, সবার আগে সিনেমা হলের পরিবেশ ঠিক করতে হবে। ভালো ছবি বানাতে হবে। এমন ছবি যা পরিবোরের সবাই মিলে দেখা যায়। জীবনের গল্প বলে, মানুষের কথা বলে এমন চলচ্চিত্র বানাতে হবে। ছবি নির্মাণে প্রযোজকদের এগিয়ে আসতে হবে। আর যারা চলচ্চিত্রে অভিনয় করবে তাদেরও চলচ্চিত্রকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতে হবে।