তবু আমারে দেব না ভুলিতে...

কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেম ও দ্রোহের কবি, সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানুষ ও মনুষ্যত্বের কবি, উত্তরণ ও জাগরণের কবি। তিনি আমাদের জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি। সাম্যের কবি নামে পরিচিত তিনি। জীবন, প্রেম ও বিদ্রোহকে এক সুতায় গেঁথেছেন বলে সংগ্রাম প্রিয়, মুক্তিকামী তারুণ্যের হৃদয়পটে ভাস্বর হয়ে আছেন কবি নজরুল। তরুণদের এগিয়ে চলার পথে অনুপ্রেরণার উৎস তিনি। আগামী ২৫ মে জাতীয় ও বিদ্রোহী এই কবির ১২০তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে কথা হয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পী ফেরদৌস আরার সঙ্গে। ব্যক্তিগত ও সমসাময়িক ব্যস্ততার পাশাপাশি কথা বলেন নজরুল ও নজরুলসংগীতের বিভিন্ন বিষয়ে। লিখেছেন জাহাঙ্গীর বিপস্নব

প্রকাশ | ২৩ মে ২০১৯, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ফেরদৌস আরা
আসে বসন্ত ফুল বনে... ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁর অঞ্চল। এই অঞ্চলের উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী হিসেবে বেশ পরিচিত এইচ এম আব্দুল হাই। পেশায় প্রকৌশলী। খাঁ সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তার চতুর্থ কন্যার জন্মের সংবাদ শুনে কন্যাকে দেখতে এলেন খাঁ সাহেব। সংগীতশিল্পী বাবার কন্যা; পৃথিবীর আলোতে দৃষ্টি মেলেই জগদ্বিখ্যাত সরোদ বাদক, সংগীতজ্ঞ মহাপুরুষের আশির্বাদে পুষ্ট হলো সেদিন। সেটিও সেই ১৯৬১ সালের গোড়ার দিকের কথা। সেই ছোট্ট কন্যাশিশুটি যেন সুরের ফুলবাগিচায় বসন্ত হয়েই এসেছিল। হঁ্যা, সুরসংগীতের ফুলবাগিচাই বটে। বাসায় রাতভর সংগীতের রেওয়াজ। প্রকৌশলী বাবার গলার সুর। পর্দানশীন-ধর্মভীরু মা মোশাররেফা বেগমের অনুচ্চ গলার সুর। বড় বোন হুরে জান্নাত, মেজ বোন নূরে জান্নাত, সেজ বোন জান্নাত আরা- সুর সাধনায়, আহরণে নিবেদিত সুরমক্ষিকা। আর ছোট বোনটি তিনি নিজে। সে কথা তো আগেই বলা হয়ে গেছে। সুরসংগীতের ফুল বনে যেন বসন্ত তিনি। আজ অবধি বাংলা গান বিশেষত নজরুলসংগীতের জগতে চিরবসন্ত হয়ে বিরাজ করছেন খাঁ সাহেবের আশির্বাদপুষ্ট, নজরুলের গানের পাখি ফেরদৌস আরা। এলো এলো রে বৈশাখী ঝড় বাবা-মায়ের ধারণা আর আকাঙ্ক্ষা নাকি ছিল ফেরদৌস আরা ছেলে হয়ে জন্মাবেন। তাই ছোটবেলায় ছেলেদের পোশাক পরিয়ে রাখতেন। আর ফেরদৌস আরাও ছিলেন দুষ্টুর শিরোমণি। রীতিমতো ছোটখাট বোশেখি ঝড়ের মতোই যেন। কেমন দুষ্টুমি করতেন? শুনুন তার কথাতেই। 'শৈশবে আমি ছিলাম দস্যি মেয়ে। বেশিরভাগ সময়ই ছেলেদের মতো প্যান্ট-শার্ট পরে ঘুরে বেড়াতাম। ঘুড়ি উড়াতাম। গাছে চড়তাম। এ গাছ থেকে সে গাছ। মূলত আমার পুরো শৈশবই কেটেছে দুরন্তপনায়।' অঞ্জলি লহো মোর সংগীতে দস্যি মেয়েটি ঘুড়ি উড়ায়। পাখির মতো উড়ে বেড়ায়। ঘুরে বেড়ায় গাছে গাছে। ধমনিতে বইছে কিন্তু সুরের ধারা। সংগীতে হাতেখড়ি শিশুকালেই। বোনেরা গান শিখতে যেতেন নন্দন কানন সংগীত পরিষদে। তিনিও সঙ্গে যেতেন। বোনেরা গানের রেওয়াজ করত, তিনি মাঠে খেলতেন। কিন্তু সুর এসে কানে লাগতেই খেলা ফেলে দৌড়ে গিয়ে জানালার গ্রিল ধরে ঝুলে থাকতেন। তন্ময় হয়ে শুনতেন। সুরপিয়াসী ছোট্টমনে গেঁথে যেত যেন সেইসব গান। এরপর বাবার বদলির সুবাদে চট্টগ্রাম ছেড়ে রাজশাহীতে চলে যান। সেখানে শাস্ত্রীয় সংগীত ওস্তাদ আব্দুল জব্বারের হাত ধরে শুরু হয় সুর সাধনা। এর কিছুদিন পর চলে আসেন ঢাকায়। এখানে এসে ওস্তাদ হিসেবে পান পাক-ভারতের প্রখ্যাত গজলশিল্পী কাদের জামিলীকে। এভাবেই ধীরে ধীরে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন। এক সময় নিজের অজান্তে, অবচেতনেই যেন গভীর প্রেমে পড়ে যান নজরুলসংগীতের। সেটি কীভাবে? জবাবে বললেন, 'ছোটবেলা থেকেই রাগাশ্রয়ী গান ভালো লাগত। গানগুলো গলায় তুলে ফেলতাম। জানতাম না কার গান সেগুলো। বড় হয়ে জানলাম সেসব নজরুলসংগীত। এই অবচেতন মুগ্ধতাই মূলত আমাকে নজরুল সংগীতশিল্পী করে তুলেছে।' সেই যে নজরুলসংগীতকে তুলে নিয়েছেন কণ্ঠে, নজরুলকে ধারণ করেছেন হৃদয়ে; মুহূর্তের জন্যও কিন্তু আর বিচ্ছিন্ন হননি। এখনো সারাদিনমান নজরুলেই আবর্তিত। তবু আমারে দেব না ভুলিতে... নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা মানুষের নিরন্তর। নজরুলের গানের মতোই- আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে। হঁ্যা, নজরুল যেমন চিরজাগরুক হয়ে আছেন আমাদের মধ্যে, তেমনই নজরুলের গান আর আদর্শ বয়ে বেড়ানো প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষ আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। অমরত্বের সেই স্বপ্নের কথা তুলে ধরলেন নজরুলপ্রেমী ফেরদৌস আরাও। বেঁচে থাকতে চান নজরুলের মধ্য দিয়েই। নজরুলের গান নিয়ে নিরন্তর গবেষণা, গবেষণালব্ধ নতুন গান নিজের কণ্ঠে ধারণ, নজরুলকে নিয়ে লেখালেখি, মোদ্দাকথা পুরোটা জীবন নজরুলে নিবেদিত। বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মিউজিক কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। নজরুলসংগীতের শুদ্ধ সুর আর শুদ্ধ বাণী শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে কাজ করেছেন সব সময়, সর্বত্র। বিশুদ্ধ নজরুলসংগীত ধারণকারী একটি আগামী প্রজন্ম গড়ে তোলার স্বপ্ন থেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন গানের স্কুল 'সুরসপ্তক'। তিনি তার গানের স্কুল নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমার সুরসপ্তকের শিক্ষার্থীরা আগামী দিনে নজরুলসংগীতের ধারক, বাহক হবে। আরেকটি খুব বড় কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন তিনি। নজরুলের শুদ্ধ বাণী ও সুরে একক কণ্ঠে হাজার গান নিয়ে গবেষণা এবং তা রেকর্ড করার কাজ করছেন। কাজটি সহজ নয় মোটেও, কিন্তু অসম্ভবও নয় বলে জানালেন তিনি। ভারতের শিল্পী স্বাগতা লক্ষ্ণীকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে বলেন, রবীন্দ্রনাথের সব গান একক কণ্ঠে রেকর্ড করেছেন স্বাগতা লক্ষ্ণী। তাহলে নজরুলের গান কেন নয়! যতদিন বেঁচে আছি কাজটি করে যাব। এরই মধ্যে দুইশ গানের রেকর্ড হয়ে গেছে বলে জানান।